নিজস্ব প্রতিবেদকঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চলমান দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযানে আওয়ামী লীগের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছে। একদিকে দুর্নীতিবাজ, অনুপ্রবেশকারী, দখলবাজ, চাঁদাবাজ, ক্যাসিনোবাজরা আতঙ্কে রয়েছে, অপর দিকে ত্যাগী, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির দক্ষ নেতাদের মধ্যে উচ্ছ্বাস আনন্দ বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, সেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষকলীগের সম্মেলনে ত্যাগী ও যোগ্যরা কমিটিতে স্থান পাবেন বলে আশা করছেন। এছাড়াও দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের জেলা-উপজেলা সম্মেলনেও ত্যাগী, যোগ্য, দক্ষ নেতা শীর্ষ পদে দায়িত্ব পাবেন বলে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা রাখছেন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর শুদ্ধি অভিযানকে দলের ত্যাগী নেতাসহ সাধারণ জনগণ স্বাগত জানাচ্ছে। দলীয় অফিসে এখন আর ভাই লীগ, হাইব্রিডদের উৎপাত নেই। ত্যাগী-নিষ্ক্রিয় নেতারা আবারও সক্রিয়। অসুস্থ্য প্রতিযোগীতা ও টাকা দিয়ে পদ পাবার ইস্যুর কারণে যারা কখনো পদের কথা চিন্তাও করেননি তারা এখন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হচ্ছেন। আর দুর্নীতিবাজরা এখন দলীয় অফিসের কাছেও ভিড়তে পারছেন না। কেউ ভিড়তে চেষ্টা করলেও ত্যাগীরা প্রতিবাদ করছেন, দুর্নীতিবাজ, অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে সচ্চার হচ্ছেন। যুবলীগের একজন পদপ্রত্যাশী জানান, যদি প্রধানমন্ত্রী এই অভিযান না চালাতেন তাহলে আমি শীর্ষ পদের আকাক্ষা কখনোই করতাম না। কিন্তু এখন আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি হয়তো প্রধানমন্ত্রী আমিকে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেবেন।
তবে দলের দুর্নীতিবাজ, বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীরা ইনিয়ে-বিনিয়ে শেখ হাসিনার অভিযানের বিরোধীতা করছে। দুর্নীতিবাজ নেতারা বলার চেষ্টা করছে, প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে একটি পক্ষ দলের নেতাদের বিরুদ্ধে অর্থাৎ বিশেষ করে এইসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াচ্ছে এবং এটি দলের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এই অভিযানের কারণে আওয়ামী লীগই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
দলীয় সূত্রে আরো জানা যায়, সম্মেলন আসলেই হাইব্রিড বিতর্কিতরা টাকা পয়সা দিয়ে কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতাদের ম্যানেজ করে পদ কিনে নেয়ার চেষ্টা করতেন। বর্তমানে জেলা বা কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছেও ভিড়তে পারছে না অপকর্মকারী নেতারা। কেন্দ্রীয় নেতারা সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন, যদি দুর্নীতি, অপকর্ম, ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িত থাকো তাহলে তাদের সামনে যাবারও দরকার নেই।
তবে দুর্নীতিবাজরাও থেমে নেই। নিজেদের ত্যাগী প্রমাণে ব্যস্ত তারা। অব্যহতি পাওয়া ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বরাবরই বলেছেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভুল বোঝানো হয়েছে তার ও অব্যহতি পাওয়া ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক শোভনের বিরুদ্ধে। সঠিকভাবে তদন্ত হলে তারা বিশেষ করে গোলাম রাব্বানী নির্দোষ প্রমাণিত হবেন।
এছাড়া সেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মোহাম্মদ আবু কাউছারকে অব্যহতি দেয়ার পর তার অনুসারী নেতারা ফেসবুকে স্ট্যাটাস ও মোল্লা আবু কাউছারের ফেসবুক পোস্টে কমেন্টের মাধ্যমে বলেছেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। যারা প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে ষড়যন্ত্র করছেন একদিন তাদেরও বিচার হবে।
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, সেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মোহাম্মদ আবু কাউছারকে অব্যহতি দেয়া; সেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথকে সম্মেলনের সকল কাজ থেকে বিরত রাখার নির্দেশ, যুবলীগের দফতর সম্পাদক আনিসুর রহমান, ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূইয়াকে বহিষ্কার; ঢাকা উত্তর সিটির ৩২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান, ৩৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজিব ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলন ময়নুল হক মনজুকে গ্রেফতার করায় দুর্নীতিবাজ, ক্যাসিনোবাজ, বিতর্কিত ও আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া রাজনৈতিক নেতারা ভয়ঙ্কর আতঙ্কে রয়েছেন। সারাদেশেই এই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দুর্নীতিবাজদের মধ্যে। কবে নাগাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শুদ্ধি অভিযান শেষ হবে সে দিনক্ষণ গণনা করছেন।
পত্রিকায় বিতর্কিত হিসেবে নাম প্রকাশ হওয়া একজন নেতা বলেন, দলের ভিতরে একটি অংশ ষড়যন্ত্র করছে। তারা ষড়যন্ত্রের শিকার। প্রধানমন্ত্রীকে তারা ভুল বুঝিয়েছে। এভাবে অভিযান না চালিয়ে ক্লাবগুলোতে নোটিশ দিয়ে ক্যাসিনো বন্ধ করলে এবং যেসব নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে সেসব কমিটি ভেঙে দিলে সহজেই সমস্যা সমাধান হতো। কিন্তু চলমান অভিযানে দলের ক্ষতি হচ্ছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযানকে আওয়ামী লীগের সকল নেতাকর্মীসহ দেশের আপামর জনগণ স্বাগত জানাচ্ছে। দুর্নীতিবাজরা নানাভাবে এর বিরোধীতা করবে তা স্বাভাবিক কিন্তু দলে দুর্নীতিবাজ, বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীদের কোন পক্ষ নেই। প্রধানমন্ত্রীকে কেউ ভুল বুঝিয়েছে, ষড়যন্ত্র হচ্ছে এসব কথা বলা উদ্ধত্তপূর্ণ। এসব দুর্নীতিবাজদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। দলে দুর্নীতিবাজ অপকর্মকারীদের সংখ্যা দলে খুবই সামান্য। এই সব দুর্নীতিবাজরা দলে না থাকলে দলের বিন্দু মাত্র ক্ষতি হবে না, বরং দল আরো বেশি শক্তিশালী হবে, জনগণের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। তিনি বলেন, সারাদেশে সম্মেলন চলছে, সহযোগী সংগঠনগুলোরও সম্মেলন হবে। সম্মেলনে কোন বিতর্কিত, দুর্নীতিবাজ, অনুপ্রবেশকারী কমিটিগুলোতে স্থান পাবে না।
দলীয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা তৈরী করে তা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের দিয়েছেন। এই তালিকা জেলায় জেলায় পাঠানো হবে। তালিকায় প্রায় একহাজার ছয়শত জনের নাম রয়েছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক বলেন, দুর্নীতি বিরোধী অভিযান চলবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাউকে ছাড় দিচ্ছেন না। কয়েকটি সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, যারা দলে অনুপ্রবেশ করেনি, নিজ দলেই একসময় ত্যাগী কর্মী ছিলেন তাদের মধ্যে যারা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরো বলেন, আমি রংপুর বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় সম্মেলন করতে গিয়ে ত্যাগীদের উচ্ছ্বাস দেখেছি। অনুষ্ঠানে কারা বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্ট তা কর্মীরাই চিহ্নত করে আমাদের বলছে। আমরা সকলের সামনে সেসব বিষয়ে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গত কয়েকদিন আগে রংপুরে একটি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কারও করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, অনেকেই নজর দারিতে রয়েছেন। অনেকেরই হিসেব তলব করা হবে। আস্তে আস্তে রাঘব বোয়ালদের সবাইকেই ধরা হবে।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমি জেনে বুঝেই এই শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করছি। জানি দলের অনেকেই মনক্ষুন্য এবং বিরোধীতা করছেন। কিন্তু এ অভিযান চলবেই। কারো তদবিরে এ অভিযান বন্ধ হবে না। আর যার অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যাবে তাকেই ধরা হবে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply