ঋতম্ভরা বন্দোপাধ্যায়, ভারত থেকেঃ পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের ওপর যখন পাকিস্তানের স্টিম রোলার চলছিল বাংলা ভাষার দাবিকে দাবিয়ে রাখার জন্য তখন বাঙ্গালীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গর্জে উঠেছিলেন। বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্বেও পাকিস্তানি শাসক জোর কোরে সেখানে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠ আসন দখল করলেও পাকিস্তানি শাসক বঙ্গবন্ধুকে শাসন ক্ষমতা দখল করতে দেয় নি।
এর আগে ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার দাবিতে আপামর জনসাধারণ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অনেককে হত্যা করেছিল। সেটাই ছিল প্রকৃত স্বাধীনতা আন্দোলনের দিন।
মুক্তি যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা যতোই বেড়েছে ততোই বাঙালিরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন।
সেদিন লাখো মানুষের কণ্ঠে জেগে উঠেছিল, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের,” আমার সোনার বাংলা”। এর আগে ১৮৪৭ সালে একই ভাবে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে কবির লেখা গান ” জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে, ভারত ভাগ্য বিধাতা” স্বীকৃতি পেয়েছিল।
এর পর ১৯৪৮ সালে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই গান ” নম: মাতা শ্রীলঙ্কা” গানটি শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। এটা অনেকেরই অজানা। কারণ গানটি বাংলা থেকে অনুবাদ করা হয়েছিল।
শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতও লিখেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত ‘আপা শ্রীলঙ্কা, নম নম নম নম মাতা, সুন্দর শ্রী বরনী’র মূল রচয়িতা ও সুরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভাবতে অবাক লাগলেও সত্যি ঘটনা। শ্রীলঙ্কা থেকে আনন্দ সমরকুন ১৯৩০ সালে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে কলা ও সঙ্গীত বিভাগে পড়তে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাত্র। ১৯৩৮ সালে তিনি গুরুদেবের কাছে তার দেশের জন্য একটি গান লিখে দেবার জন্য অনুরোধ করেন। প্রিয় ছাত্রের এই অনুরোধ ফেরাতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। বাংলায় লিখে দিলেন ‘নম নম শ্রীলঙ্কা মাতা’। সুর করে গানটি তুলেও দিলেন আনন্দকে। ১৯৪০ সালে বিশ্বভারতীর শিক্ষা শেষ করে কবিগুরুর এই গানটি নিয়ে দেশে ফিরে গেলেন আনন্দ সমরকুন। ১৯৪৬ সালে গানটি সিংহলিভাষায় অনুবাদ করে একটি রেকর্ড বের করলেন শ্রীলঙ্কায়। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে শ্রীলঙ্কা স্বাধীনতা পেল ১৯৪৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি।
১৯৫০ সালে নতুন দেশের জাতীয় সঙ্গীত ঠিক করার জন্য স্যার এডউইন ওয়াসজার এটনির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। সেই সময় আনন্দ তার অনূদিত ‘নম নম শ্রীলঙ্কা মাতা’ গানটি ওই কমিটির কাছে দেন। কমিটি ১৯৫১ সালের ২২ নভেম্বর ওই গানটিকেই শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এভাবেই প্রিয় ছাত্রকে লিখে দেওয়া কবিগুরুর মূল গানটির অনুবাদ হয়ে গেল আরও একটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত। শ্রীলঙ্কায় রবীন্দ্রচর্চার পথিকৃৎ ছিলেন আনন্দ। সিংহলি ভাষায় তিনি বহু রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্র সাহিত্য। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনও করতেন। কবিগুরুর এই প্রিয় ছাত্র আনন্দ সমরকুন অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে ১৯৬২ সালের ৫ এপ্রিল আত্মহত্যা করেন।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply