ঋতম্ভরা বন্দোপাধ্যায় , কলকাতা: আজ ৮ জুলাই। ভারত তথা বিশ্বের কিংবদন্তী কম্যুনিস্ট আইকন প্রয়াত জ্যোতি বসুর আজ জন্ম বার্ষিকী। প্রসঙ্গত আমি গর্বিত যে আমারও জন্ম বার্ষিকী আজই। আর এই কারণেই খুব ছোট্ট বেলায় যখন স্কুলে জ্যোতি বসুর জন্মদিন পালন করা হতো,তখন আমারও জন্মদিন পালন করা হতো আমাদের বাড়িতে। এইভাবেই তার অজান্তেই আমাদের একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল জ্যোতি বসুর সঙ্গে। আমি যখন চার বছরের তখন আমার বাবা একদিন দিল্লি থেকে কলকাতায় এসে বললেন, দিল্লির সুপ্রিম কোর্টের বিখ্যাত ব্যারিস্টার ও অল ইন্ডিয়া প্যান্থারস পার্টির সভাপতি ভীম সিং কাশ্মীর থেকে তিনটি বাস নিয়ে কলকাতায় আসবেন। মুখ্য মন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করে কাশ্মীরে শান্তি স্থাপনে তার সহযোগিতা কামনা করতে। একজন জবরদস্ত মুখ্যমন্ত্রী হলেও ভীম সিং আসছেন জেনে জ্যোতি বসু তার উপদেষ্টা জয়কৃষ্ণ ঘোষকে নিজের সল্ট লেকের বাড়িতে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভীম সিংয়ের দলবল সমেত সকলের থাকার ব্যবস্থা জ্যোতিবাবুই করেছিলেন সল্ট লেক স্টেডিয়ামের গেষ্ট হাউসে। ভীম সিং অবশ্য আমাদের সল্ট লেকের বাড়িতেই তার সেক্রেটারিকে নিয়ে থাকলেন। জ্যোতিবাবুই এবং রাজ্যপালের নির্দেশে আমাদের সল্ট লেকের বাড়িটি তখন কম্যান্ডো তথা ব্ল্যাক ক্যাট সুরক্ষা বাহিনী ঘিরে রেখেছিল। নির্ধারিত দিনের সকালে ভীম সিংয়ের দলবল গিয়ে হাজির হলেন জ্যোতি বসুর বাড়িতে। ভীম সিং আংকেল আমার বাবা মানস ব্যানার্জি, মা অনুরাধা ব্যানার্জি ও আমাকে নিয়ে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কে ভি রঘুনাথ রেড্ডির পাঠানো বুলেট প্রুফ গাড়িতে করে জ্যোতি বসুর বাড়িতে। ভীম সিং আংকেল তখন Z ক্যাটাগরির সুরক্ষা পেতেন। মুখ্য মন্ত্রী জ্যোতি বসুর বাড়ির ২০০ গজ দূরে সুরক্ষা বাহিনী সবকটি গাড়ি আটকে দিয়েছিল শুধু আমাদের গাড়িটি ছাড়া। তবে মাকে এবং আমাকে সুরক্ষার কারণে বাইরে গেষ্ট রুমে বসিয়ে রেখেছিল। ভীম সিং আংকেল ও বাবা ভিতরে গেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্যোতি বসু আমাদের ভিতরে ডেকে নিলেন। তিনি জয়কৃষ্ণ ঘোষকে উত্তেজিত হয়ে বলেন, ” সেকি ছোট্ট একটা মেয়ে ও তার মা কি আমার সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হতে পারে!!! শিগগিরই তাদের নিয়ে আসুন। তারপর ভীম সিং আংকেলের কাশ্মীরি সদস্যদেরও ডেকে নিলেন। আমাকে দেখেই তিনি তার চেয়ারের পাশে দাঁড় করিয়ে খুব আশীর্বাদ করলেন। আমি “দাদু” সম্বোধন করে হাত বাড়িয়ে কোলে উঠতে চাইলে বৃদ্ধ দাদু মুচকি হাসলেন। আমি তাকে বললাম, অসমের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল মহন্ত আংকেল তো আমাকে কোলে নেন। জ্যোতি দাদু বলেছিলেন, তিনি বুড়ো হয়ে গেছেন। তারপর পাশে দাঁড় করিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে আমাকে ধরে রাখলেন। যখন জানলেন আমার জন্মদিনও ৮ জুলাই তখন খুব খুশি হয়ে আমাকে তার প্রতিটি জন্ম দিনে তার বাড়ি অথবা অফিসে যেতে বললেন। সেদিনের কথা খুব মনে পড়ে যায়। অতবড় একজন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষের সংস্পর্শে এসে নিজেকে গর্বিত মনে করি। অনেকেই হয়তো জানেন না, জ্যোতি দাদুর আদি পৈতৃক নিবাস ছিল পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের নারায়ন গঞ্জের বারাদিতে। ভারতের প্রখ্যাত বাম রাজনীতিক ও পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মূখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ১৯১৪ সালের ০৮ জুলাই কোলকাতায় জন্মগ্রহন করলেও তাঁর পিতা ডাঃ নিসিকান্ত বসু নারায়নগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার বারদী ইউনিয়নের অধিবাসী ছিলেন। ঢাকা থেকে প্রায় ২০ কি: মি: দূরে এই বারদী ইউনিয়নের চৌধুরী পাড়ায় জ্যোতি বসুর একটি পৈতৃক বাড়ি রয়েছে। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় জ্যোতি বসু তার এই পৈতৃক বাড়িটি পাঠাগারে রূপান্তরিত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। বাঙ্গালির অকৃত্রিম বন্ধু এই মহান রাজনীতিবিদ ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপা বাড়িটি পাঠাগারে রূপান্তরিত করার ঘোষণা করেন। বর্তমানে এটি পাঠাগার ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply