মূলত ভারত উপমহাদেশের মানুষ ছিল বৈদ্য, সনাতন হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায় ভুক্ত। ইসলামের প্রচার বা দাওয়াত এতদ্ঞ্চলে অনেকন দেরিতে পৌছেছে। সেই মাধ্যম গুলি হলো (১) বানিজ্যিক সম্পর্ক (২) মুসলিম শাসন ও (৩) ইসলাম প্রচারে ওলি আউলিয়াদের আগমন।
বিশেষ করে সনাতনী হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বর্ণভেদ তীব্র আকারে ছিল। উচু জাতের হিন্দু নিচু জাতের হিন্দুদের সহ্য করতে পারতো না। উচু বর্নের ব্রাহ্মণ নিচু বর্নের নমশূদ্রদের মানুষ বলে গন্য করতেন না। তাদেরকে না না নির্যাতন, নিপিড়ন করতো। অবজ্ঞার চোখে দেখতো। তাই নিন্ম জাতের হিন্দুরা উচু বর্নের হিন্দুদের মনে মনে ঘৃনা করতো। আরব থেকে যারা ইসলাম প্রচারে আসতো বা ব্যবসা বানিজ্যের জন্য যারা এই অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে আগমন ঘটেছে তাদের ব্যবহার আচার আচরনে মুগ্ধ হয়ে এবং ইসলামে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নাই, উচু বর্নে নিচু বর্ন নেই। কেউ কারো গোলাম নয়। সকলে মহান আল্লাহর গোলাম তাদের কাছ থেকে এমন সব বক্তব্য শুনে বিশেষ করে নিন্ম বর্নের নির্যাতিত নমশূদ্র শ্রেনী ইসলামের আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ফলে অধিকাংশ নিন্ম বর্নের হিন্দু সম্প্রদায় ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে।
ঐতিহাসিক এলিয়ড ও ডাউসন তাদের The history of India as told by It’s on historians গ্রন্থে বলেছেন, ৬৩০ খ্রীস্টাব্দে ভারতীয় উপকূলে মুসলিম পর্যটকদের বহনকারী প্রথম জাহাজ দেখা গিয়েছিল। এইচ জি রলিনসন তার ভারতে ” প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস গ্রন্থে দাবী করেছেন যে, প্রথম আরব মুসলমানেরা খ্রীঃ ৭ম শতাব্দীর শেষ ভাগে ভারতীয় উপকূলে বসতি স্থাপন করেছিল।
জনপ্রিয় ঐতিহ্য অনুসারে ৬৬১ খ্রীঃ শেখ ওবায়দুল্লাহ মালাবার উপকূলের ঠিক পশ্চিমে অবস্থিত লাক্ষাদ্বীপ – দ্বীপপুঞ্জে ইসলাম নিয়ে আসেন। তার কবরটি এন্ড্রোটি দ্বীপে অবস্থিত বলে মনে করা হয়। চেরামন- পেরুমলদের উপকথা অনুসারে প্রথম ভারতীয় মসজিদ টি ৬২৪ খ্রীঃ বর্তমান কেরালায় কদুঙ্গালুরে চের রাজ বংশের শেষ শাসক চেরমল- পেরমল আদেশে নির্মিত হয়েছিল।
৬২৯ খ্রীঃ মালিক দিনার প্রথম ভারতীয় চেরমন জুম্মা মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন বলে মনে করা হয়। মালাবারে মাপিগলারা সম্ভবত প্রথম সম্প্রদায় যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।
জনপ্রিয় ঐতিহ্য অনুসারে ভারত থেকে ২ জন পরিব্রাজক মৌলাই আব্দুল্লাহ যার পূর্বের নাম বালাম নাথ এবং মৌলাই নুরুদ্দিন যার পূর্বের নাম রুপনাথ- ইমাম মুস্তানসিরের দরবারে গিয়েছিলেন ( ১০৩৬ খ্রীঃ) এবং সেখানে তারা এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছিলেন এবং ভারতে ধর্ম প্রচার করতে ফিরে এসেছিলেন।
ভারত বর্ষে বিভিন্ন সময় মুসলিম শাসকদের শাসনামলে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটে। বিশেষভাবে ১২০৩ খ্রীঃ কুতুব উদ্দিন আইবেক এর সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির হাতে পুর্ব ভারত তথা বাংলাদেশ অঞ্চল শাসনের মধ্য দিয়ে ইসলাম প্রসার লাভ করে।
হযরত উমর (রা.) শাসনামলে বাহরাইন ও ওমানের শাসক প্রখ্যাত সাহাবী হযরত উসমান বিন আব্দুল আস সাকার্ফী তার দুই ভাই আল হাকাম ও মুগিরাকে ভারত বর্ষে প্রেরণ করে ছিলেন। তারাই প্রথম ভারত উপমহাদেশে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেন। এই কাফেলায় আরও বেশ কয়েকজন সাহাবী ছিলেন- (১) হযরত আবদুল্লাহ বিন ওতবান, (২) আস ইয়াম বিন আমর তাজিমী, (৩) সোহার বিন আল আবদী অন্যতম। এদের অভিযানগুলো হয়েছিল ভারত বর্ষেের সিন্ধু, দেবল, সিজিস্তান অঞ্চলে। বাংলাদেশীয় অঞ্চলে ইসলাম এসেছে মূলত আরব বনিকদের হাত ধরে। তারা বিভিন্ন ধরনের মসলা, উৎকৃষ্ট মানের বস্ত্র, সুগন্ধি ও কাচামালের ব্যবসা করতো। এই সব ইসলাম প্রচারক, খোদা ভীরু ওলি আউলিয়াদের সুমহান চরিত্র ও তাদের ধর্মীয় বানীতে মুগ্ধ হয়ে এ দেশের মানুষ ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। এবং ইসলামের সুশীতল ছায়ায় দীক্ষিত হয়ে থাকে।
উপমহাদেশের দক্ষিনাঞ্চল অর্থাৎ সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে তাদের আগমন ঘটেছিল সবচেয়ে বেশি। যার ফলে বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম, ঢাকার উপকূলীয় অঞ্চলে এবং রংপুরে সে সব নওমুসলিমদের বসতি উঠেছিল ব্যপক ভাবে।
ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে বিভিন্ন সময় আরব, ইরান, ইরাক, ইয়েমেন, ওমান থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য ওলি আউলিয়াদের আগমন ঘটেছে। তাঁদের নাম নিন্মে দেয়া হলোঃ
তিনি ১১৩৮ খ্রীঃ পূর্ব পারস্যে শাকস্থান রাজ্যে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি ইরাকের বাগদাদে বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানীর সহচার্য্যে ৫৭ দিন অবস্থান করেন। তার জীবনীতে বর্নিত আছে যে, এই সময় আব্দুল কাদের জিলানী তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন যে, ইরাকের দায়িত্ব শায়েখ শিহাব উদ্দিন সোহরাওয়ার্দী কে আর হিন্দুস্তানের দায়িত্ব আপনাকে দেয়া হলো। তিনি এর পর আরব হতে ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে লাহোর পারে দিল্লি হয়ে আজমিরে বসতি স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন ভারত বর্ষে ইসলাম প্রচারে কিংবদন্তীতুল্য একজন ঐতিহাসিক সুফি ব্যক্তিত্ব। তার মাধ্যমে বহু লোক ইসলাম গ্রহন করেন।
১৩০৩ খ্রীঃ মাত্র ৩২ বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য অধুনা বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে আগমন করেন। সুদূর ইয়েমেন থেকে পরিবার পরিজনের মায়া ত্যাগ করে শুধু ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে মানব জাতিকে সঠিক পথে দীক্ষা দেয়ার জন্য চলে আসেন। তার সাথে আরও ৩৬০ জন আউলিয়া এসেছিল। তারা কেউ আর নিজ দেশে ফিরে যান নি। এ দেশেই তাদের সমাহিত করা হয়েছে।
মামা শাহজালালের যোগ্য সহযোগী হিসাবে তিনিও ইসলাম প্রচারে মহান ব্রত নিয়ে নিজ দেশ ও পরিবারের মায়া ত্যাগ করে সিলেটে চলে আসেন এবং ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।
২৬১ হিজরি তে সুদূর ইরান থেকে তিনি চট্টগ্রাম এসে ইসলাম ধর্ম প্রচারে আত্ন নিয়োগ করেন। তার সাথে বহু সফর সঙ্গী ছিলেন যারা সকলেই নিজের দেশ ও পরিবার পরিজনের মায়া ত্যাগ করে ইসলাম প্রচারে এসেছিলেন। এবং তাদের মৃত্যুর পর এদেশেই সমাহিত করা হয়েছে।
৪৪৫: হিজরি তে নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন এই মহামানব। এবং তার মৃত্যুর পর এ দেশেই সমাহিত করা হয়।
এই মহামানব একই ভাবে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য ফরিদপুরে চলে আসেন।
৬১৫ হিজরিতে তিনি ইসলাম প্রচারে রাজশাহী অঞ্চলে চলে আসেন। তিনি ছিলেন রাজশাহী অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ ইসলাম প্রচারক।
৬৭৭ হিজরিতে ইসলাম প্রচরে নারায়ণগঞ্জ আসেন তিনি। তিনিই প্রথম হাদিসের দরস দেন।
এই সব ওলি আউলিয়াদের অধিকাংশ আরব ইয়েমেন, ইরাক খোরাসন মধ্য এসিয়া থেকে এসেছিলেন। কিন্তু তারা আর নিজেদের দেশে ফিরে যান নি। ধর্ম প্রচার করতে করতে এদেশেই চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। তাদের ত্যাগ তিতিক্ষার ফলে আমরা ইসলামের আলোর পথ সঠিক পথ খুঁজে পেয়েছি। মহান আল্লাহ যেন তাদের সবাইকে জান্নাতের মহান সন্মানিত আসনে সমাসীন করেন। আমীন।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply