আওয়ামীলীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পরিবারের সদস্যদের হত্যাকান্ডের ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিল জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার না করার ইনডেমনিটি দিয়েছিল। খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল বলেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর গঠিত আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান টমাস উইলিয়ামকে বাংলাদেশে আসার ভিসা দেয়নি জিয়াউর রহমান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্মরণসভায় (ভার্চুয়াল) গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে শপথ নিয়ে বলেন, মুজিববর্ষে পিতা তোমায় কথা দিলাম, তোমার বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে আমরা হাসি ফোটাবই। এই বাংলা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে চলবে। এই বাংলার মানুষ উন্নত জীবন পাবে- এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা, এটাই আমাদের শপথ। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত খুনিদের সব ধরনের মদদ দিয়েছিল এই জিয়াউর রহমান। খুনিরা নিজেরাই সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছে যে, জিয়াউর রহমানের মদদেই তারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। শুধু জিয়াই নয়, তার স্ত্রী খালেদা জিয়াও খুনিদের মদদ দেওয়াসহ একই কাজ করেছে। তার স্বামী (জিয়াউর রহমান) দিয়ে গেছেন জাতির পিতার হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি, আর তিনি (খালেদা জিয়া) এসে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে তাদের ইনডেমনিটি দিয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের এই আলোচনা সভায় দলীয় কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রান্ত থেকে আলোচনায় অংশ নেন দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবু আহমেদ মন্নাফি ও উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপের সভাপতিত্বে আলোচনা সভার শুরুতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্ট শহীদ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সব সদস্যের রুহের মাগফিরাত কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নস্যাৎ করে দিতেই বঙ্গবন্ধুসহ আমাদের পরিবারের সব সদস্যকে হত্যা করা হয়। খুনি রশিদ, ফারুক, হুদা, ডালিম, নূর, শাহরিয়ার, মাজেদ এরা সবাই সেনাবাহিনীর সদস্য ছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করতে কে তাদের মদদ দিয়েছিল? উৎসাহিত করেছিল? শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুরই ক্যাবিনেটের মন্ত্রী বেইমান মোশতাক ও জিয়াউর রহমানরা জড়িত ছিল। অথচ এই জিয়াউর রহমানকে মেজর থেকে মেজর জেনারেল পর্যন্ত পদোন্নতি দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুই। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর বিবিসিতে সাক্ষাৎকার দিয়ে খুনি কর্নেল রশিদ ও ফারুক নিজেরাই বলেছে, জিয়াউর রহমানের মদদেই এই হত্যাকান্ড (বঙ্গবন্ধু) ঘটাতে তারা সক্ষম হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর নিয়ম ভেঙে বেইমান মোশতাককে রাষ্ট্রপতি করা হয়। আর রাষ্ট্রপতি হয়েই মোশতাক জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান বানায়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সব ধরনের মদদ দিয়েছিল এই জিয়াই। তিনি বলেন, বেইমান-মীরজাফররা বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারে না। মীরজাফরও তিন মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি, খুনি মোশতাকও পারেনি। শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত খুনিদের বিদেশে পাঠানো, বিদেশে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল এই জিয়াউর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের যাতে বিচার না হয় সেজন্য ইনডেমনিটি জারি করা হয়েছিল। আমাদের বিচার চাওয়ার কোনো অধিকার ছিল না, সেটি পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই শেষ হয়নি, বঙ্গবন্ধু পরিবারের আর কে কে বেঁচে আছে তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়। ভয়ে আমাদের পরিবারের যারা বেঁচে ছিলেন তারা অনেকেই ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ করা হয়, কেউ নাম নিলে তার খোঁজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট লন্ডনে আমরা শোক সভা করি। সেখানে ব্রিটিশ এমপি টমাস উইলিয়ামকে প্রধান করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ঘটনা তদন্তের জন্য একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন করা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, টমাস উইলিয়ামকে তদন্তের জন্য ঢাকায় পাঠানোর। কিন্তু তখন রাষ্ট্রপতি পদে থাকা জিয়াউর রহমান টমাস উইলিয়ামকে ঢাকায় আসতে ভিসা দেয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল বলেই ভীত হয়ে ওই তদন্ত কমিশনকে ঢাকায় আসার ভিসা দেয়নি এই জিয়া। দীর্ঘ ছয় বছর রিফিউজি হিসেবে দেশের বাইরে থাকার পর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরলে তাঁকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে জিয়াউর রহমান ঢুকতে দেয়নি উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, আমাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করার পর যখন দেশে ফিরে আসি, তখন আমাকে ৩২ নম্বরের বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। রাস্তায় বসে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সদস্যদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া-মোনাজাত করেছি।
ওই সময়ের পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়। স্বাধীনতাবিরোধী, একাত্তরের গণহত্যাকারীদের মদদদানকারী, রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের জিয়াউর রহমান প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উপদেষ্টা বানায়, রাজনীতি করার সুযোগ দেয় এবং নিষিদ্ধ থাকা ভোটের অধিকারও তাদের ফিরিয়ে দেয়।
উচ্চ আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সেনাবাহিনীর রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন ভঙ্গ করে একাধারে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হয়ে এই জিয়া সঙ্গীনের খোঁচায় সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে। উচ্চ আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞতা যে, তারা পরবর্তীতে একটা রায় দিয়ে বলেছে, ’৭৫-পরবর্তী সকল ক্ষমতা দখল অবৈধ এবং ওই সময়ে জারিকৃত অডির্ন্যান্সগুলোও বাতিল করার আদেশ দেওয়া হয়। এই রায়ের মাধ্যমে পুরো জাতিকে এক অশুভ অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছে আমাদের উচ্চ আদালত।
স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার স্ত্রী খালেদা জিয়ারও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও পুরস্কৃত করার ঘটনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন এদেশের মানুষের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন। মানুষকে শোষণের হাত থেকে রক্ষা করে তাদের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল জাতির পিতার একমাত্র লক্ষ্য। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কর্নেল পরবর্তী দেশটির সেনাপ্রধান কর্নেল বেগের জিয়াকে লেখা একটা চিঠির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে কর্নেল বেগ ওই চিঠিতে লিখেছিল- ‘তোমার কাজের জন্য ধন্যবাদ, তোমার স্ত্রী-ছেলেরা আমাদের কাছে ভালোই আছে।’ চিঠিতে জিয়াকে নতুন কাজ দেওয়ার কথা বলেছিল। এর অর্থ কী? জিয়া কী ওই সময় স্বাধীনতাকে নস্যাৎ এবং দেশ স্বাধীন হলে ১৫ আগস্ট ঘটানোর দায়িত্ব পেয়েছিল? তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রশিদ-ফারুককে এমপি বানিয়েছিল এবং খুনি রশিদকে বিরোধী দলের নেতা পর্যন্ত বানিয়েছিল। খুনিদের প্রতি খালেদা জিয়ার এত বেশি দরদ কেন? শুধু তাই নয়, পলাতক খুনি পাশাকে পদোন্নতি দিয়ে সব টাকা তার স্ত্রীকে দিয়েছিল, আরেক খুনি খায়রুজ্জামানকে অবসর থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এনে পদোন্নতি দিয়েছিল- ঠিক যখন বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের রায় বের হবে তার আগে। এসব কাজও করেছে খালেদা জিয়া।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চালু করেছিল জিয়া-খালেদা জিয়ারা। ১৯টা ক্যুর মাধ্যমে নির্বিচারে হাজার হাজার সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সদস্যকে হত্যা করেছিল এই জিয়া। দুই থেকে আড়াই হাজার সেনা সদস্যকে ওই সময় হত্যা করা হয়, একের পর এক ক্যুর ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের সেনাবাহিনীই। সেনাবাহিনীর সদস্যের অনেক মায়ের কোল তারা খালি করেছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তার লাশ পর্যন্ত তখন পাওয়া যেত না। আর তখন নির্বাচনের নামেও চলেছে প্রহসন। ১০ হুন্ডা, ২০টা গুন্ডা- নির্বাচন ঠান্ডা- এটাই ছিল ওই সময়ের নির্বাচন।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে সমালোচনাকারীদের উদ্দেশ করে শেখ হাসিনা বলেন, এখন এক্সটা জুডিশিয়াল কিলিং নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন। কিন্তু সবাই ভুলে গেছে যে, ২০০১ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া দেশে একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড চালিয়েছে। অপারেশন ক্লিনহার্টের নামে শত শত মানুষকে নির্বিচারে ওই সময় হত্যা করা হয়েছে। আমাদের গবেষণা কেন্দ্রে (সিআরআই) হামলা করে লুটপাট এবং তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার স্বামী (জিয়াউর রহমান) দিয়ে গেছেন জাতির পিতার হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি, আর তিনি (খালেদা জিয়া) এসে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে তাদের ইনডেমনিটি দিয়ে গেছেন। সারা দেশে খুনের রাজত্ব তৈরি করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই করোনার মধ্যেও সরকারের পাশাপাশি আমাদের নেতা-কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যন্ত অসহায় মানুষের পাশে ছুটে গিয়েছে, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। আর কোনো রাজনৈতিক দল বা সংস্থাকে তো দেখিনি আওয়ামী লীগের মতো করোনার এই দুঃসময়ে মানুষকে সহযোগিতা করতে গিয়ে এমনভাবে অকাতরে নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়। শুধু মানুষকে সহযোগিতাই নয়, দুঃসময়ে কৃষকের ধান কেটে মাথায় করে তা বাসায় পৌঁছে দিয়েছে আমাদের নেতা-কর্মীরা।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply