এম শহিদুল ইসলাম, টাঙ্গাইল প্রতিনিধিঃ
নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে টাঙ্গাইলের নারী ফুটবলাররা। তবে তাদের চলার পথ এখনও সহজ নয়। বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ বাধা সমাজ ও পরিবার দুদিক থেকেই। নারী সংগঠকরা বলছেন, নারী-পুরুষের বৈষম্যগত মানসিকতা দূর না হলে নারী দিবসের সফলতা পাওয়া যাবে না।
প্রান্তিক এলাকায় পুরুষের সমানতালে ফুটবলার হতে চাওয়া মোটেও সহজ কথা নয়। তাই এই প্রত্যেক নারীর গল্প যেন-একেকটি জীবনযুদ্ধের কাব্য। ফুটবলার হবার নেশায় এদের কেউ মাথার চুল ফেলে দিয়ে ঠেকিয়েছেন বাল্যবিবাহ আবার কেউ হয়েছেন পরিবার থেকে বিতাড়িত। সামাজিক বঞ্চনার চিত্র যেন আরও ভয়াবহ।
বাল্যি বিয়ে এড়াতে মাথার চুল কেটে ফেলা ফুটবলার মিলি তাদেরই একজন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াবস্থায় বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা ফুটবল টুর্নামেন্টে জেলা পর্যায়ে খেলার সুযোগ পায় মিলি (১৩)। সেই খেলায় ভালো পারফর্মেন্স করে সে। এতে খেলার প্রতি আকৃষ্ট হয়। তবে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার পরিবার। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মিলিকে বিয়ে দিতে চায় পরিবার। এতে বিয়ে এড়াতে কৌশলে মাথার চুল কেটে ফেলে ফুটবল খেলায় মনোনিবেশ করে। পরে ধীরে ধীরে মিলি ফুটবলে ভালো করে। ভর্তি হয় মোনালিসা উইমেন্স স্পোর্টস একাডেমিতে। এখন মিলির পরিবার তাকে সহযোগিতা করছে।
মিলির মতো আরও এক নারী ফুটবলার ঋতু (১৬)। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াবস্থায় ফুটবলের প্রতি নেশা তার। ঋতুর মা মারা যাওয়ায় তার নানীর কাছে মানুষ। তার নানী অন্যের বাড়িতে কাজ করে যে রোজগার করেন সেই টাকা দিয়ে সংসার চালিয়ে ঋতুর পড়াশুনার খরচ যোগাতেন। এবার এসএসসিতে পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলা চালিয়ে যাচ্ছে। ঋতু বর্তমানে বিকেএসপি ক্যাডেট ফুটবলার হিসেবে ভর্তি হয়েছে।
শুধু মিলি বা ঋতুই নয় টাঙ্গাইলে হাজারও জয়িতা, বৈরীতা ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
ফুটবলার সেলিনা বলেন, প্রতিবেশি অনেক মানুষই আমার বাবা-মাকে বলতো মেয়েকে খেলাধুলা না করার জন্য। খেলাধুলা করলে মেয়ের বিয়ে হবে না। পরে এক পর্যায়ে পরিবার থেকেও খেলাধুলা করতে নিষেধ করা হয়। এরপর অনেক কষ্ট করে খেলাধুলা ধরে রেখেছিলাম। আবার যখন দুই বছর পর আরও একটু বড় হলাম তখনও মানুষজন ভিন্নভাবে কটূ কথা শোনাতো। এখন বড় হয়ে গেছি। সবাই বলে, এখন খেলাধুলা করতে হবে না। আবার হাফ প্যান্ট পরে খেলি। এটা পছন্দ করে না অনেকেই।
আম্বিয়া বলেন, বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। পরবর্তীতে কাকার কাছে মানুষ হয়েছি। বাড়ি থেকে কোনও সহযোগিতা পাইনি। বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিয়েছে অনেক। পরে কৌশলে বাড়ি থেকে চলে গিয়ে ফুটবল ক্লাবের ম্যাডামের সহতায়তায় খেলাধুলা করছি। বাড়িতে সম্প্রতি ফোন করে খরচ চেয়েছিলাম দেয়নি। তারা বলেছে, আমার জন্য খরচ চালানো নাকি হারাম। সবার অমতে খেলাধুলা করায় পরিবার থেকে কোনও সহায়তা পাই না। বাড়িতে গেলেই তারা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবে। আমি খেলাধুলা করতে চাই।
মিলি বলেন, আমার স্বপ্ন আমি এক সময় জাতীয় দলে ফুটবল খেলবো। সেই স্বপ্ন থেকে খেলায় এত মনোযোগ। ছেলেবেলাতেই পরিবার থেকে বিয়ে দিতে চাওয়ায় মাথার চুল কাটতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমি এখন বিকেএসপিতে চান্স পেয়েছি। পরিবারও এখন আমাকে সহায়তা করছে এবং বিয়ের জন্য আর চাপ দিচ্ছে না।
ঋতু বলেন, ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি। বাবা অন্যত্র বিয়ে করেছে। সেও অসুস্থ। পরে নানীর কাছে মানুষ হয়েছি। নানী অন্যের বাসায় কাজ করে আমাকে মানুষ করেছে। আমি এখন বিকেএসপিতে পড়াশুনা করছি। খেলাধুলায় ভালো করে দেশের জন্য গৌরব অর্জন করতে চাই।
তবে এসব নারী খেলোয়ারদের চলার পথ এখনও সহজ নয়। বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ বাধা পদে পদে।
জেলার নারী সংগঠকরা বলছেন, নারী-পুরুষের বৈষম্যগত মানসিকতা দূর না হলে নারী দিবসের সফলতা পাওয়া যাবে না। বর্তমান প্রান্তিক সমাজে পুরুষের সমানতালে ফুটবলার হতে চাওয়া মোটেই সহজ কথা নয়। তাই একদিন বৈষম্যময় মানসিকতা দূর হবে। পুরুষের সমানতালে বাধাহীন এগিয়ে যাবে সকল নারী।
অভিভাবকরা বলেন, মেয়েদের খেলাধুলা করতে দেয়ায় সামাজিভাবে অনেক কটূ কথা শুনতে হয়। অনেকেই বলে মেয়েদের কেন খেলাধুলা করতে হবে? তারপরও অনেক পরিবার এগিয়ে আসছে। যাতে পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও ভালো করতে পারে।
টাঙ্গাইলের মোনালিসা উইমেন্স স্পোর্টস একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা কামরুন্নাহার খান মুন্নি বলেন, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা দূর না হলে নারীর চলার পথ সহজ হবে না। সামাজিকভাবে তাদের সহযোগিতা করতে হবে। অর্থবৃত্ত বা স্ট্যাটাস না দেখে অসহায় ও দরিদ্র এসব কিশোরীদের সহায়তায় সকলের এগিয়ে আসা উচিত। এতে সরকারের উচিত সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আর্থিকভাবে তাদের সহায়তা করা।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply