ঋতম্ভরা বন্দ্যোপাধ্যায়: সারা বিশ্বে যতোই আধুনিকতার ছোঁয়াচ লাগুক না কেন, যতোই দ্রুতগামী যানবাহন, বুলেট ট্রেন, মনোরেল,স্পুটনিক, রকেট এসে সাড়া জাগিয়ে দিক না কেন, ভারতে ব্রিটিশের বপন করা ট্রাম যুগে যুগে বাঙালির স্বপ্নে, চলনে,ভাবনায় জড়িয়ে রয়েছে। প্রেম,ভালবাসা, আড্ডা, নিরাপদে যাত্রার একমাত্র সহায়ক ছিল এই ট্রাম।ট্রাম অনুভূতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে রয়েছে। সেই স্কুল জীবনের শুরু থেকেই ট্রামে শুরু হয়েছে পথ চলা। ট্রেনের সেই হো হুস শব্দ করে স্টার্ট করা , তারপর অংআং শব্দ করে গতি নেয়া একটা স্বপ্নের মতো মনে হয় আজও।ট্রাম – সেকেন্ড ক্লাস কামরা। এটাতে কোনো পাখা নেই। ছোটবেলার বেলাগাছিয়া ট্রাম ডিপো থেকে ১ নম্বর , ২ নম্বর , ১১ নম্বর ট্রামে করে হিন্দু স্কুলে যাওয়ার স্মৃতিটা মনে পাকাপাকি ভাবে গেঁথে আছে। অফিস টাইমে ওয়ান-ওয়ে হয়ে যাওয়া কলেজ স্ট্রীট ধরে সোজা স্কুলের গেট অবধি পৌঁছে যাওয়ার আর কোনো উপায়ই ছিল না। বাবা মাও নিশ্চিন্তে ট্রামে তুলে দিয়ে কাজে চলে যেতেন। জানতেন কন্ডাক্টর কাকু ঠিকই আমাদের সাবধানে নামিয়ে দেবেন। ফেরার সময়ও একই রুটিন। স্কুলের কোনো স্টাফ ট্রামে তুলে দিত। কোনো রাস্তা পার হতে হত না। বাস স্টপে নেমে এক ছুটে সোজা বাড়ি।
অফিস টাইমে ভয়াবহ ভিড় হত সেই ট্রামে। আমরা অবশ্যই কোনো কাকুর কোলে বা জানলার ধারে। সৌজন্যে কন্ডাক্টর কাকু। সেই ট্রামের জানলা দিয়ে দেখতাম বেনারসী প্যালেস, সংস্কৃত বুক ডিপো , নজরুল ইসলাম এর ছবি সহ অগ্নি বীণার মুরাল ( ডি. এম. লাইব্রেরি ), কখনো স্বামীজীর বাড়ির তলায় অধুনা লুপ্ত চাচার হোটেল থেকে প্রেমিকার রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসছে কলেজ ফেরত প্রেমিক। আসল ফাউল কাটলেট পাওয়া যেত সে দোকানে। পুরু মুরগির ফিলে ভর্তি গোলাকার স্বর্গীয় কাটলেট- থেকে একটা হাড় সুকৌশলে বেরিয়ে আছে। সঙ্গে প্রমাণ সাইজের চাকা চাকা গোলাকৃতি একটুকরো করে পেঁয়াজ , টমেটো ও শসা। শ্রীমানি মার্কেটের উল্টো দিকে সেই চৌধুরী ওয়াচ কোম্পানির গাড়িবারান্দা ওলা বিশাল ঘড়ির দোকানটা, যার বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং এ চা বাগানে নিবিড় মনে চা পাতা বাছাতে ব্যস্ত এক রমণী কে দেখা যেত। একটি আধুনিক ঘড়ি তার হাতে শোভা পাচ্ছে। আর্য্য সমাজ , ব্রাহ্ম সমাজের বড় বড় বাড়িগুলো দেখতে দেখতে কখন যে স্কুলের গেটে পৌঁছে যেতাম খেয়ালই নেই। কন্ডাক্টর কাকু মৃদু প্রশ্রয় মিশ্রিত বকুনি দিয়ে নামিয়ে দিতেন। কখনো ফেরার সময় ওয়াই এম সি এর ক্যান্টিন থেকে ঘুগনি খেতে খেতেই ছুট। এপার থেকে চিৎকার করে ডাকলে গাড়ি দাঁড়িয়ে যেত। ড্রাইভার কাকু ধমক দিয়ে তুলে নিতেন। পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়েও বকুনি খেতে হত মাঝে মাঝেই। ট্রামের ভেতরে একটা খাপ মত। তাতে একটা তারিখ লেখা কার্ড থাকত। সেটা বোধ হয় অল ডে পাস বা মান্থলি করার তারিখ। স্কুলের অনেক বন্ধু কেই দেখেছি পকেট থেকে একটা মান্থলি বের করে কন্ডাক্টর কাকু কে দেখিয়ে তার একধার থেকে দৈনিক একটা করে কাগজ ছিঁড়ে ফেলে দিতে। সেই ট্রামে আবার মাঝে মাঝে চেকার উঠত। তার কাজ ছিল টিকিট টা দেখে আরেকটি পাঞ্চ করে ফেরত দেওয়া। দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় পাখা থাকত না। ভাড়াও একটু কম পড়ত যত দূর মনে পড়ে।
আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে জীর্ণ বিবর্ণ হয়েও সেসবের কিছু কিছু আজও টিকে আছে। নেই শুধু চাচার হোটেল আর বেলাগাছিয়া ট্রাম ডিপো থেকে ছাড়া ট্রাম গুলো। স্বামীজীর বাড়িটা সংস্কার হওয়ার সময় উল্টো ফুটে স্থানান্তরিত হয়েছিল চাচার হোটেল। তারপর থেকে আর বিশেষ চলেনি বোধ হয়। শেষ বছর দুয়েক আগে সরস্বতী পুজোয় কাটলেট খেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল ঠিক ভালো চলছে না। তারপর তো বন্ধ ই দেখি । এদিকে বছর কয়েক আগে বেলগাছিয়া ব্রিজের ট্রাম লাইনের কাজ শুরু হল। জানতাম লাইন সংস্কার হচ্ছে। কিন্তু তারপর তো আর চালুই হল না। আগেই বন্ধ হয়ে গেছিল গ্যালিফ স্ট্রীট ট্রাম ডিপো। বেলাগাছিয়া ডিপোর ট্রাম চালু না হলে চির তরে হারিয়ে যাবে শ্যামবাজার থেকে শিয়ালদা গামী ট্রাম। ক্লাস সিক্স-সেভেন নাগাদ একবার বর্ষা কালে বিধান সরণি তে ট্রাম বন্ধ হয়ে খুব মুশকিলে পড়েছিলাম । তখন ভরসা ছিল গ্যালিফ স্ট্রীট ডিপোর ১২/১৫ নম্বর। সে ট্রাম আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড হয়ে শিয়ালদা জগৎ সিনেমার সামনে থেকে বেঁকে কলেজ স্ট্রীট হয়ে হাওড়া ব্রিজের তলার ডিপোতে চলে যেত যতদূর মনে পড়ে।
আবছা মনে পড়ে। হয়ত হাওড়া ব্রিজের ওপর ট্রাম চলতে ও আমি দেখেছি। তখন স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে বোধ হয়। বিনুর স্বপ্নে দেখা মস্ত বিছের মত ট্রামের এলীগরী ভালোই অনুভূত হয়েছিল। কতদিন দেখেছি গ্যালিফ স্ট্রীট এ রোববারের শখের বাজারের অসহ্য ভিড়ের মধ্যে ডিপো থেকে আধপথ বেরিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহাকালের মত একটি ট্রাম। ফ্যান্সি মার্কেট থেকে বেড়িয়ে ময়দানের ঘাস চিরে ছুটে গেছি ট্রামে করে। বাগবাজার লকগেটের পাশের ডিপো টা বোধ হয় চালু ছিল কিছুদিন আগেও। বন্ধুরা মিলে ডিপোর পাশের গেট দিয়ে ঢুকে যেতাম লকগেটের কাছে। আড্ডা দিতে দিতে সূর্যাস্ত, যতক্ষণ না মশার জ্বালায় অতিষ্ট হয়ে উঠতে হচ্ছে। বেরিয়েই চলন্ত ট্রামে একলাফে উঠে পড়তাম দীর্ঘ পথশ্রমের খাটনি খানিকটা লাঘব করার ধান্দায়।
পি সি সরকারের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে ট্রাম যেত শুনেছি গড়িয়া হাট ডিপো তে। জানিনা সে এখন চলে কিনা। সম্ভবত রবীন্দ্র সরণী বা অন্য কোনো বেশ প্রাচীন ট্রাম লাইনের ধার ঘেষে ল্যাম্প পোস্ট এর মত ব্রিটিশ স্থাপত্যের তোরণ থাকত , যা থেকে ট্রামের তার ঝুলে থাকত। আজকের মত পুরোপুরি ওভারহেড ইলেকট্রিক কেবলিং নয় সেটা। পুরোনো লোহার সি টি সি র স্থায়ী ট্রাম স্টপেজ বোর্ড। লেখা – এখানে ট্রাম থামবে। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে অনেকদিন অবধি ছিল ট্রামের ঘোড়ার জল খাওয়ার জায়গা। সেটাই বোধ হয় এখন একটা বড় পানীয় জলের কলতলা আর মুক্ত স্নানাগার। এরকম অনেক জলের আধার শুনেছি রাস্তায় থাকত ঘোড়ায় চলা ট্রামের ধুলো ওড়া কমানোর জন্য আর ট্রাম লাইনকে মসৃন রাখার জন্য। নোনাপুকুরে ছিল ট্রাম কোম্পানির নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। পরবর্তী কালে খরচা কমানোর জন্য কলকাতা ইলেকট্রিক সাপ্লাই এর সাথে চুক্তি করার পর সে ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়।
ট্রাম কোম্পানি ট্রাম কে বাঁচানোর , জনপ্রিয় করার অনেক চেষ্টা করছে। আগেকার মত দ্বিতীয় শ্রেণী বলে এখন আর কিছু নেই। একটি রঙিন ট্রাম খাদ্য পণ্যের বিপণনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। ভাড়া লাগবে না। চড়ে বসলেই হল। সুন্দর শহরের বুকে এক টুকরো জয় রাইড হয়ে যাবে। সঙ্গে মিলবে নানা রকমের মুখরোচক খাবার। আছে একটি নামি জামা কাপড়ের সংস্থার বিপণন ট্রাম। আস্ত একটা দু কামরার শপিং মল সেটি। শহর জুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে ছোট এক কামরার সুসজ্জিত শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ট্রাম। আছে গোটা দিন ট্রাম ভাড়া করে ঘোরার ব্যবস্থা। তখন মাধ্যমিক। রোববার করে মাঝে মাঝেই দেখতাম চিতপুর থেকে গ্রে স্ট্রীট ধরে ছুটে যাচ্ছে হেরিটেজ সফরের ট্রাম। বছর খানেক আগে একবার পুজোর সময় বোধ হয়, দেখেছিলাম বয়স্কদের পুজো ঘোরানোর জন্য বিশেষ ট্রাম। ধর্মতলায় ট্রাম ডিপোর একটি ট্র্যাকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা আছে ট্রাম জাদুঘর স্মরণিকা। পরিবেশ বান্ধব এই যান জড়িয়ে আছে শহরের প্রতিটি শিরায় ধমনীতে। শ্যামবাজার থেকে ট্রামে উঠে ধর্মতলা হয়ে এসপ্লেনেডে যেতাম। মনুমেন্ট এর পাশ দিয়ে হেঁটে শহরের শোভা দেখতে দেখতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে যেতাম। ফুচকা খেতে খেতে পার্কে ঘুরতাম। আবার ট্রামে চেপে ফিরে আসতাম শ্যামবাজারে। সেগুলো আজ সেলুলয়েডের মতো ভেসে ওঠে। বেঁচে থাকুক ট্রাম। বেঁচে থাকুক ভালোবাসা।
পুনশ্চ : কয়েক বছর আগের লেখা। এর মধ্যে অনেক ট্রাম রুট বন্ধ হয়ে গেছে। শ্যামবাজার ডিপো থেকে ধর্মতলা গামী ঐতিহ্যবাহী ৫ নম্বর ট্রাম ও মাঝে বন্ধ ছিল। আবার চালু হয়েছে। পরিসেবা আগের মত নেই। অনেক দাঁড়ালে কদাচিৎ একটার দেখা মেলে। আর এখন তো শুনছি যাত্রী পরিবাহী ট্রামই নাকি আর থাকবে না। পুজো পরিক্রমার ট্রাম ও এবার আর চলবে না। তবুও চাইব । বেঁচে থাকুক ট্রাম।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply