ঋতম্ভরা বন্দ্যোপাধ্যায়: এবারের ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয়েছে কাতারের পছন্দমতো । এটি অন্যতম আরবীয় শব্দ। বিভিন্ন অর্থ , কখনো মুক্ত, আবার কখনো জ্ঞানী। এটি আসলে ফার্সি শব্দ দানা অর্থাৎ জ্ঞানী।
সাগরে দানবের মতো ফুঁসছে ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’। রাত পোহাতেই বঙ্গোপসাগরে দানা বেঁধেছে এই শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। মঙ্গলবার সকালে গভীর নিম্নচাপ তৈরি হয়ে হয়েছে। তা আরও ঘনীভূত হয়ে বুধবার শক্তিশালী সাইক্লোনের রূপ নিয়েছে। ভারতের আবহাওয়া অধিদফতর (IMD) অনুসারে, বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর এবং শুক্রবার ২৫ অক্টোবর রাতের মধ্যে ওড়িশায় ল্যান্ডফলের সম্ভাবনা রয়েছে।
‘দানা’-র প্রভাবে ওড়িশা এবং বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে অত্যন্ত ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। আবহাওয়া কর্তৃপক্ষের ঘোষণা অনুসারে শুক্রবার পর্যন্ত উভয় রাজ্যে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। ‘দানা’-র অর্থ নিয়ে অনেকেরই কৌতূহল রয়েছে। ‘দানা’ বা ‘দানাহ’ নামের আরবি ভাষায় সাংস্কৃতিক তাৎপর্য রয়েছে, যেখানে এর অর্থ ‘সবচেয়ে নিখুঁত আকারের, মূল্যবান এবং সুন্দর মুক্তা।’
সাগরে নিম্নচাপের সময় বাতাসের প্রচণ্ড ঘূর্ণায়মান গতির ফলে সংঘটিত বায়ুমণ্ডলীয় উত্তাল অবস্থাকে সংক্ষেপে ঘূর্ণিঝড় বলা হয়। বাতাসের এই একটানা ঘূর্ণায়মান গতি যখন একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছায়, তখনই এর নামকরণ করা হয়। আটলান্টিক মহাসাগর ও এর আশপাশের অঞ্চলে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটারে উঠে গেলে নিম্নচাপ ঝড়ে পরিণত হয়। আর এ সময়ই ঘূর্ণিঝড়টিকে একটি নাম দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।
ভারত মহাসাগরের ঝড়গুলোর নামকরণ করে ১৩টি দেশ। সেগুলি হল, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার , মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ওমান, ইরান, সৌদি আরব, ইয়েমেন, সংযুক্ত আরব ও কাতার।
ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের পেছনে মূল কারণ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে জনসাধারণের সতর্কতা। এই উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে বাতাসের গতিবিধি ও আসন্ন দুর্যোগ নিয়ে গবেষণা করা হয়ে থাকে।
এই নামটি সাধারণত পারস্য উপসাগরের আরব রাজ্যগুলিতে ব্যবহৃত হয়, যা তাদের ঐতিহ্যবাহী মুক্তা ডাইভিং পেশার জন্য পরিচিত।এই প্রেক্ষাপটে, বিভিন্ন ধরনের মুক্তর আলাদা আলাদা নাম দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে ‘দানা’ সেরার একটির প্রতিনিধিত্ব করে। উপরন্তু, ফার্সি ভাষায়, ‘দানা’ শব্দের অনুবাদ ‘জ্ঞানী’।
তবে ‘দানা’ নামটি কাতার কর্তৃক একটি আন্তর্জাতিক ঘূর্ণিঝড় নামকরণ পদ্ধতির অংশ হিসাবে প্রস্তাব করা হয়েছিল, যার লক্ষ্য হল সম্ভাব্য আবহাওয়ার বিপর্যয় সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঝড় চেনার উপায় সহজতর করা।
‘DANA’ এর উচ্চারণ অঞ্চল এবং ভাষার উপর নির্ভর করে ‘দানা’ নামের একাধিক উচ্চারণ রয়েছে, এটিকে বহুমুখী এবং সাংস্কৃতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। আরবি অঞ্চলে, দানাকে সাধারণত DA-nuh হিসাবে উচ্চারণ করা হয়। এই উচ্চারণটি একটি নরম ‘এ’ শব্দের উপর জোর দেয়, এটিকে স্বতন্ত্র অথচ সহজ করে তোলে। ফার্সি ভাষায়, যেখানে ‘দানা’ শব্দের অর্থ ‘বুদ্ধিমান’, এটিকে ‘DAA-নাহ’ হিসাবে উচ্চারণ করা হয়, একটি প্রসারিত ‘a’ সহ উভয় সিলেবলের উপর জোর দেয়।
ঘূর্ণিঝড়ের নামগুলি সদস্য দেশগুলি দ্বারা বার্ষিক বা দ্বিবার্ষিক বৈঠকের সময় জমা দেওয়া হয় এবং প্রতিটি নাম অনুমোদিত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট মানদণ্ড পূরণ করতে হবে।তালিকার নামগুলি পর্যায়ক্রমে ঘোরানো হয়, নতুন পরামর্শগুলির সাথে অবসরপ্রাপ্ত নামগুলি প্রতিস্থাপন করা হয় – যেগুলিকে পুনঃব্যবহারের জন্য খুব মারাত্মক বা ধ্বংসাত্মক বলে মনে করা হয়৷
১৮০০ -এর দশকের শেষের দিকে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে এই প্রথাটি তৈরি হয়েছিল, যখন রোমান ক্যাথলিক সেন্টদের নামে ঝড়ের নামকরণ করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, আবহাওয়াবিদরা ঝড়ের ট্র্যাকিং এবং যোগাযোগকে আরও সংগঠিত করার জন্য মেয়েদের নামে ঝড়ের নামকরণ শুরু করে।
১৯৫৩ সালে, ইউএস ওয়েদার সার্ভিস ফোনেটিক বর্ণমালার উপর ভিত্তি করে মহিলাদের নামের একটি প্রমিত তালিকা চালু করে। তবে লিঙ্গ পক্ষপাতের সমালোচনার পর, ১৯৭৯ সালে এই প্রথা বদলায়। পর্যায়ক্রমে পুরুষ এবং মহিলা উভয় নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় ঝড়ের নাম দেওয়ার সময়।
বর্তমানে, ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ আঞ্চলিক নামকরণ তালিকার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই তালিকাগুলি পর্যায়ক্রমে আন্তর্জাতিক কমিটি দ্বারা অনুমোদিত এবং আপডেট করা হয়, এটি নিশ্চিত করে যে ঘূর্ণিঝড়ের নামগুলি জনসাধারণের উচ্চারণের জন্য উপযুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করে।
বৃহস্পতিবার সকালে ওড়িশা-পশ্চিমবঙ্গের কাছে পৌঁছে গেছে ‘দানা’। বুধবার থেকেই আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টির নামকরণ করেছে কাতার। এই ‘দানা’ নামের অর্থ মুক্ত বা স্বাধীনতা। ওড়িশা উপকূলে দানা আছড়ে পড়ছে বলেই প্রাথমিক ভাবে জানিয়েছে আবহাওয়া দফতর। তাই আগে থেকে সতর্ক রয়েছে ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন।
ভিতরকণিকা ও ধারমার মাঝে বৃহস্পতিবার রাত ও শুক্রবার সকালের মধ্যে ল্যান্ডফলের সম্ভাবনা দানার। তীব্র ঘূর্ণিঝড় বা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে গতিবেগ থাকবে সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়। পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগরে এই ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়ার পর বাঁক নিয়েছে দানা। পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিক ছেড়ে এখন শুধুই উত্তর-পশ্চিম দিকে এগোচ্ছে। আগামীকাল সকালের মধ্যে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply