পাবনার বিলুপ্তির পথে আজ ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা। এক সময় খুব জনপ্রিয় ছিলো এই খেলা। প্রতিটি পাড়া মহল্লায় খেলোয়াড়দের দলনেতার উদ্যোগে গড়ে উঠত লাঠি খেলার দল। আর পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতো এই খেলা।
ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হতো কোন গ্রামের কোন মাঠে বা কার বাড়িতে কোন সময় এই খেলা অনুষ্ঠিত হবে। নিজেদের নিত্যদিনের কাজ দ্রুত সমাপ্ত করে ছুটে যেত খেলা দেখার জন্য। বাড়ির আঙিনায় এই খেলা দেখার জন্য ঘরের চালে গাছের ডালে ভীড় জমাতো যুবকেরা আর বেড়ার ফাঁকে, জানালা খুলে খেলা দেখতো মা-বোনেরা । আর সে দিনের সেই কাঠের টুল, পিড়ি পেড়ে, খেজুর পাতার পাটি/চাটাই ও ধানের নাড়ায় বসে খেলা দেখত বৃদ্ধ, যুবা, কিশোর শিশুরা । দর্শকদের হাতে তালি আর মুখের জয়ধ্বনি খেলোয়াড়দের আনন্দ যোগাত।
কিন্তু কালের আবর্তে আজ লাঠি খেলার সেই বিনোদন ভুলতে বসেছে দেশের মানুষ। বর্তমানে নতুন করে লাঠি খেলার কোনো সংগঠন বা দল তৈরি হচ্ছে না। পাবনা জেলার আতাইকুলা থানাধীন শোলাবাড়ীয়া গ্রামের লছের মাঝি আর ঝড়ু মিস্ত্রির নেত্রীত্বে বিশাল লাঠি খেলার দল দল এবং চরপাড়া গ্রামের এবাদদ খান এর নেতৃত্বে আরো একটি লাঠিখেলার দল ছিল। তাদের খেলা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বিগত পহেলা জানুয়ারী মাসে ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয় খেলার মাঠে দুদিন ব্যাপী মেলায় আমার চেষ্টা লাসের মাঝি’র নেতৃত্বে মেলায় লাঠি খেলা দেখিয়ে প্রসংসা কুড়িয়েছিল।
খেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঢোল আর লাঠির তালে তালে নাচ, অন্যদিকে প্রতিপক্ষে লাঠির আঘাত হতে আত্মরক্ষার কৌশল অবলম্বনের প্রচেষ্টায় টান টান উত্তেজনায় বিরাজ করত খেলোয়াড় ও দর্শকদের মাঝে। খেলোয়ারদের হাঁক ডাক “ এই বাহ্, হা..হা , আ..আ..আ.., কোন..বা..দেশে.. বাড়ী, কোন..বা..দেশে..বাড়ী, তো..মা..র.. প..রি..চ..য়… দেওগো আওয়াজে লাফিয়ে উঠতো।
পাবনা জেলার শোলাবাড়য়িা গ্রামের বয়বৃদ্ধ লাঠি খেলোয়াড় তোয়াজ মহুরী জানান, এই খেলার জন্য লাঠি সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা হয়। তবে প্রতিটি লাঠি হয় প্রায় তৈলাক্ত। প্রত্যক খেলোয়াড় তাদের নিজ নিজ লাঠি দিয়ে রণকৌশল প্রদর্শন করেন। খেলার স্থানে লাঠির পাশাপাশি যন্ত্র হিসেবে ঢোল, কনেট, ঝুনঝুনি ও বিভিন্ন প্রকার বাঁশি ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়াও সঙ্গীতের পাশাপাশি এ খেলার সঙ্গে চুড়ি নৃত্যও দেখানো হতো। খেলায়া সংখ্যা কমপক্ষে ৪৫ জন প্রয়োজন।
সম্প্রতি পাবনা জেলার আতাইকুলা থানাধীন শোলাবাড়ীয়া গ্রামে লুৎফররের বাড়িতে এই খেলা অনুষ্ঠিত হয়। লুৎফর বলেন, গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা আজ বিলুপ্তপ্রায়। আমাদের অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের লাঠি খেলা রয়েছে। আগে দেখতাম, গ্রামের সাধারন মানুষেরা বাংলা বর্ষবরণ, ঈদের দিনে, বিবাহ, চড়কপূজা, সুন্নতে খাৎনা উপলক্ষে এ লাঠি খেলা আয়োজন করতো। আমার দাদা ও বাবা লাঠি খেলায় পারদর্শী ছিলেন।
বাপ- দাদার সেই স্মৃতি ধরে রাখার জন্যই আমি লাঠি খেলার আয়োজন করেছি। আর এ লাঠি খেলা দেখেতে গ্রামের নারী-পুরুষসহ সকল শ্রেণীর লোক ভীড় জমিয়েছিল। আমার বন্ধু এ নিবন্ধ লেখক আমাদের লাঠি প্রচারের জন্য পাবনা সমিতি ঢাকা কর্তৃক আয়োজিত দুই দিনের মেলায় ঢাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয় খেলার মাঠে নিয়ে গিয়েছিল। সেই খেলা বিটিভি সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রিন্ট মিডিয়াতে প্রচারিত হয়েছে। আজ অবধি বন্ধু নজরুলের জন্য আমাদের মা চাচীরা দোয়া করেন। আমার বন্ধুর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
শোলাবাড়ীয়া গ্রামের বয়োবৃদ্ধ লাঠি খেলোয়াড় জলিল মন্ডল (৮১) অতীতের স্মৃতিচারণ করে বলেন, এই নাটি খেলা দিন দিন আড়াইয়া যাইতাছে। আমাগোরে হাতেকার ফেলোয়াররা অনেকেই বাইচা নাইে তাদের মধ্যে উস্তাদ লছের মাঝি, ঝড়ু মিস্ত্রি, ওমেদ মল্লিক এরা আমাদের সংগঠক আছিল। আগে দেখছি, খেলায় যারা পারছে তাগোরে গোস্ত দিয়া খিচুড়ি খিলাইছে গ্রামের ধনী মানুষেরা। এগোরে হাতে পাড়ার মানুষেরাও খাইছে। এই নাটি খেলা আর দেহিনা বাবা, আগে বল খেলছে পাও দিয়া, এহুন আত দিয়া বল ঢেলায় আর কাঠ দিয়া বাইরায় আমার নাতিপুতি ও তার হাতেকার বন্ধুরা। বইসা বইসা তাই দেহি।
লাঠি খেলা আজ কালে গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দুসস এর উদ্যোগে আগামীতে আমার এই হারানো খেলা উৎজীবিত করার জন্য উদ্দ্যোগী হব।
শেখ নজরুল ইসলাম
সাবেক অধ্যক্ষ,
লেখক ও গবেষক,
পরিচালক প্রশসন, দুসস, প্রকাশক, ইনভেন্ট পাবলিকেশন
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply