রুমী রচিত গ্রন্থ
মাওলানা জালালউদ্দিন মুহাম্মদ রুমি ফার্সি সাহিত্যের এমন একটি নক্ষত্রের নাম, যার আলো মানুষকে প্রজ্জলিত করে চলেছে ৮০০ বছরের বেশি সময় ধরে। ১২০৭ সালে জন্ম নেয়া এই আধ্যাত্মিক কবি, ইসলামী ব্যক্তিত্ব, ধর্মতাত্ত্বিক, অতীন্দ্রবাদী এবং সুফী ১৭ ডিসেম্বর ১২৭৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।। তাঁর জ্ঞানের পরিসীমা শুধু পারস্য অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। নিজ গুনে, স্বমহিমায় তা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে, সাহিত্য প্রেমী প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। পশ্চিমা বিশ্বের নামী দামি সাহিত্যিক ইয়েটস, শেক্সপিয়র, নেরুদা, উইলিয়াম কার্লোসদের ছাপিয়ে মাওলানা রুমির মসনবী বই এখন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, পঠিত।
এরই স্বীকৃতিস্বরুপ জিতে নিয়েছে আমেরিকার ‘বেস্ট সেলিং পয়েন্ট’ অ্যাওয়ার্ড। সারা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে রুমির কবিতা সমূহ। মাওলানা রুমি তাঁর কবিতার মাধ্যমে যে দিক দর্শন এবং প্রেম আর ভালবাসার বার্তা তুলে ধরেছেন তা দেশ, কাল, জাতি এবং ভাষার গন্ডিকে অতিসহজেই অতিক্রম করে গিয়েছে। কবিতার পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু গদ্যও লিখেছেন এবং সে গদ্যের মাধমে যে সংলাপ এবং উক্তি অবতারনা করেছেন, তা যুগে যুগে মানুষের হৃদয়কে জয় করে চলেছে। মাওলানা রুমি আধ্যাত্মিকতা, অতীন্দ্রিয়বাদ এবং সুফিবাদের শ্রেষ্ট ধারক এবং বাহক ছিলেন। তিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে মানবজাতির আত্মার রহস্য উন্মোচন করেছেন এবং সৃষ্টিকর্তার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে প্রেমকে বেছে নিয়েছেন। এই জগতবিখ্যাত সুফি-সাধক, মরমী কবি মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির জীবনী নিয়ে কিছু আলোচনা।
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি নিজেকে কখনোই ধর্মের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। আবার তিনি ধর্ম থেকে বিচ্যুতও হয়ে যান নি। তিনি মানব আত্মার সাথে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ককে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং তাঁর কবিতার মাধ্যমে তা তুলে ধরেছেন। যে কারনে সকল ধর্মের মানুষের কাছেই তিনি সমানভাবে জনপ্রিয় ছিলেন। এই কারনেই তাঁর মসনবী শরিফ সকলের কাছে সমানভাবে গ্রহনযোগ্য। আর জালালউদ্দিন রুমির সাহিত্য মান নিয়ে উচ্ছ্বসিত হবার মত বিষয় রয়েছে। তাঁর রচিত গ্রন্থ পড়ে নামী দামী ইংরেজ সাহিত্যিকদের কাছে ইংরেজী সাহিত্যকে পানসে বলে মনে হয়েছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রিসার্স স্কলার এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত সামির আসাফ তার ‘The Poet of the Poets’ নিবন্ধে লিখেছেন-
‘গভীরতার মানদণ্ডে রুমির তুলনায় শেক্সপিয়রের মান হচ্ছে মাত্র ১০ ভাগের এক ভাগ।’
বিভিন্ন ভাষার পাশাপাশি বাংলাতেও জালালউদ্দিন রুমির মসনবী বই অনুবাদ হয়েছে। অনুবাদিত মসনবী শরিফে রুমির জীবনের পূর্ণাঙ্গ পরিচিতি পাওয়া যায়। সেখানে থেকে মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির জীবনী অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো। যার দরুন পাঠক তাঁর জীবনের পূর্ণাঙ্গ পরিচিত লাভ করবেন। পাশাপাশি মাওলানা রুমির সাথে সম্পর্কিত বেশ কিছু ঘটনা জানতে পারবেন। সময় নিয়ে পড়ার অনুরোধ রইলো।
বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক, আধ্যাত্মিক কবি মাওলানা রুমির নাম মুহাম্মদ, উপাধি জালালউদ্দিন। তার পিতার নামও মুহাম্মদ, উপাধি সুলতান বাহাউদ্দীন ওলাদ। পিতামহের নাম হোসাইন বলখী। হোসাইন বলখী উত্তর ইরানের বলখ নগরের অধিবাসী ছিলেন।
রুমীর বংশগত সম্পর্ক নক্ষত্র সদৃশ বিখ্যাত এবং বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের সাথে সম্পর্কযুক্ত। রুমি পিতার পূর্ব পুরুষদের নবম ধাপে হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রা) সহিত মিলিত হন এবং মাতার দিকে হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুর সাথে মিলিত হন।
মাওলানা রুমীর পিতামহ হোসাইন ইবনে আহমেদ অতি উচ্চ পর্যায়ের সুফী এবং বুজুর্গ লোক ছিলেন। তৎকালীন সুলতান এবং বাদশাহগন তাকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। খোরাসান হতে ইরাক পর্যন্ত এই সাম্রাজ্যের মহাপ্রতাপশালী বাদশাহ মুহাম্মদ শাহ খাওয়ারেযমী স্বীয় কন্যা মালাকায়ে জাহানকে তার সহিত বিবাহ দেন। মাওলানা রুমীর বুজুর্গ পিতা সুলতান বাহাউদ্দিন ওলাদও তৎকালের উচ্চশ্রেণীর ওলি, বিজ্ঞ আলেম, আধ্যাত্মিক সুফি এবং বিশিষ্টজন। মাওলানা রুমি হলেন বাদশাহ মুহাম্মদ শাহ খাওরেযমীর দৌহিত্র।
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির জন্ম এবং জন্মস্থান:
মাওলানা রুমী খোরাসানের অন্তর্গত বলখ শহরে ৬০৪ হিজরীর ৬ই ববিউল আউয়াল তারিখে জন্মগ্রহন করেন। তার পূর্বপুরুষদের বসবাস বলখেই ছিল। তার পিতা সুলতান বাহাউদ্দীন ওলাদ যৌবন বয়সেই খ্যাতনামা আলেম, পারদর্শী মুফতী ছিলেন।
জ্ঞানে-বিজ্ঞানে তথা সর্ববিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। সমগ্র খোরাসানের জটিল ও কঠিন ফতওয়ার সমস্যাবলীর সমাধান তিনি করতেন। রুমির পিতার উপাধি ছিল সুলতানুল উলামা।
কোনো এক শুভ রাত্রিতে বলখ শহরের প্রায় তিনশত (৩০০) জন সু-খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞ আলেম ও মুফতীগণ একযোগে স্ব স্ব স্থানে অবস্থিত অবস্থায় স্বপ্নে দেখলেন দো-জাহানের সরদার রাসূল (সঃ) একটি সবুজ বর্ণের তাবুর অভ্যন্তরে উপবিষ্ট আছেন। তাঁর পার্শ্বে সুলতান বাহাউদ্দীন ওলাদ উপবিষ্ট রয়েছেন। নবীজীর বিশেষ অনুকম্পা ও মেহেরবানীর স্নেহাশীষে ধন্য হয়েছেন। এমন কি, হুযুরের মোবারক মুখনিঃসৃত বানী ছিল – আমি বাহাউদ্দীনকে ‘সুলতানুল উলামা’ উপাধিতে ভূষিত করে দিলাম।
পরদিন সমস্ত আলেম, মুফতীগণ সুলতানুল উলামাকে এই শুভ স্বপ্ন ব্যক্ত করার জন্য এবং অভিনন্দন জানানোর জন্য তাঁর খেদমতে হাজির হলেন। তিনি বললেন, বেশ ! আল্লাহর রাসূল (সঃ) এর জবান মুবারকে শোনার পর তো আপনাদের বিশ্বাস হয়েছে যে, আমি ‘সুলতানুল উলামা’। সুলতানুল উলামা অর্থ আলেমকূলের সম্রাট।
বাহাউদ্দীন ওলাদের এলমী মজলিসের নিয়ম-পদ্ধতি শাহী ধরনের ছিল। ভোর থেকে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত সাধারণ দারস, পাঠদান, এবং যোহরের পর বিশিষ্ট সহচরদের সমক্ষে এলম এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূক্ষতত্ত্ব ও গূঢ়রহস্য বর্ণনা করতেন। তাঁর মুখমন্ডলে ভয় ও ভীতির চিহ্ন প্রকট থাকতো সর্বদা। মনে হতো যে, আখেরাতের ফেকেরে তিনি সর্বদা চিন্তান্বিত।
মাওলানা রুমির পিতার দেশত্যাগ:
সুলতানুল উলামা বাহাউদ্দিন ওলাদের নপ্রতিপত্তি দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকল, ওয়াজ-নছীহতের প্রতিক্রিয়া সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। মুরীদ ও ভক্তদের সংখ্যা অগনিত হারে বৃদ্ধি পেল।
সুলতানুল উলামা বাহাউদ্দীন ওলাদ স্বীয় ওয়াজের মধ্যে ইউনানী বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকদের নিন্দাবাদ করতেন, কিছু কিছু লোক আসমানী কিতাব উপেক্ষা করেন বৈজ্ঞানিকদের নিরর্থক উক্তিসমূহকে নিজেদের মত ও পথ হিসাবে গ্রহণ করে ছিলেন। এই ধরনের লোক কিরূপে মুক্তি ও নাজাতের আশা করতে পারে?
জনসমক্ষে এই নিন্দাবাদের কারণে বাহ্যিক এলমের পণ্ডিতদের অন্তরে আঘাত লেগেছিল। তারা সুলতানুল উলামার প্রতি বিরূপ ভাব পোষণ করতে লাগলেন। কিন্তু যেহেতু তৎকালীন বলখের বাদশাহ মোহাম্মদ খাওয়ারেযম শাহ ছিলেন সুলতানুল উলামা বাহাউদ্দীন ওলাদের আত্মীয় ও ভক্ত সুতরাং রাজদরবারে সুলতানুল উলামার বিরুদ্ধে কোন প্রকার অভিযোগ করার সুযোগ তারা পেত না।
একদিন বাদশা সুলতানুল উলামার সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে তাঁর খেদমতে হাজির হয়ে দেখলেন, বিরাট জনতার ভীড়। বাহ্য এলেমের একজন দার্শনিক আলেম বাদশাহের মোসাহেব হিসাৰে সঙ্গে ছিলেন । বাদশাহ তাঁকে বললেন, জনতার এত বড় ভীড় আলেম, ফাযেল, আমীর সরদারের সমন্বয়ে বিরাট জনসমাবেশ ! আলেম সাহেব সুযোগ বুঝে তীর ছুড়লেন। তিনি বললেনঃ জি হুযুর ! এর কোন ব্যবস্থা না করলে অদূর ভবিষ্যতে রাজকীয় ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার প্রবল আশংকা রয়েছে।
বাদশাহ খাওয়ারেযমের অন্তরে আলেম সাহেবের এই উক্তিটি রেখাপাত করল। বাদশাহ জিজ্ঞাসা করলেন, তাহা হলে কি করা উচিত? আলেম সাহেব পরামর্শ দিলেন যে, ধনভাণ্ডার এবং দূর্গসমূহের চাবিগুচ্ছ সুলতানুল উলামা সাহেবের নিকট পাঠিয়ে দিয়ে বলুন, লোকজনতো সকলেই আপনার, আমার কাছেতো শুধু চাবিগুলি; সুতরাং এগুলিও আপনিই নেন। প্রস্তাব অনুযায়ী কাজ করা হল।
সুলতানুল উলামা (র) এই পয়গাম শ্রবণ করে বিনীতভাবে বললেনঃ ইসলামের বাদশাহকে আমার সালাম জানিয়ে বলবেন, এই অস্থায়ী রাজত্বের ধনভাণ্ডার, লোক-লস্কর বাদশাহদের উপযোগী, আমরা ফকির-দরবেশ। এদের সাথে আমাদের কি সংস্রব? আমি অতি সন্তুষ্টচিত্তে দেশত্যাগ করছি। আগামী শুক্রবার ওয়ায করার পর দেশান্তরিত হব। বাদশাহ পরম সুখে ও সন্তুষ্ট চিত্তে এখানে সাঙ্গপাঙ্গ ও দোস্ত-আহবাবসহ পরমানন্দে রাজত্ব করুক।
এই সংবাদ মত দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল। বলখ শহরে হুলস্থুল পড়ে গেল। এতে বাদশাহ অত্যন্ত শংকিত হয়ে পড়লেন। বাদশাহ সুলতানুল উলাম (র) সমীপে দূত প্রেরণ করলেন । রাত্রে বাদশাহ স্বয়ং তার খেদমতে হাজির হয়ে তাকে দেশান্তরের সংকল্প পরিত্যাগ করার জন্য সকাতরে নিবেদন করলেন; কিন্তু মাওলানা বাহাউদ্দিন ওলাদ(র) সংকল্পে দৃঢ়পদ রইলেন এবং বাদশাহর আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন।
অন্য উপায় না পেয়ে বাদশাহ করজোড় অনুরোধ করলেন, আমার প্রতি দয়াপরশ হয়ে অন্ততঃ এতটুকু করবেন যে, জনসাধারণের অগোচরে আপনি এ কাজ করবেন, অন্যথায় দেশে ভীষণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। মাওলানা বাহাউদ্দিন ওলাদ (র) এই প্রস্তাব মঞ্জুর করলেন। মাওলানা শুক্রবার ওয়াজ করলেন, ওয়া্জের মধ্যে খাওয়ারেযম শাহের প্রতি সাবধানবাণী উচ্চারণ করে গেলেন যে, আমার যাওয়ার পর মঙ্গোলিয়ার রাজা এই বলখ শহর ভস্মীভূত করার জন্য আসছে। ওয়াজের পর বিশিষ্ট মুরীদগণের মধ্য হতে ৩০০ (তিন শত) জন মুরীদকে সঙ্গে নিয়ে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়লেন।
সুলতানুল উলামার দেশত্যাগ করার কিয়ৎকাল পরে মঙ্গোলিয়ার অগণিত তাতারী সৈন্য বলখ আক্রমণ করল । এই সংঘর্ষে বলখের দশ লক্ষ লোক প্রাণ হারাল। সমগ্র দেশ ছারখার হয়ে গেল।
এদিকে মাওলানা হিজরতের পথে যেখানেই পৌছতেন, তথাকার আমীর-উমারা ও রঈস লোকগণ তাঁর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে আগমন করতেন এবং অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করতেন। এইরূপে ৬১০ হিজরী সনে তিনি নিশাপুরে উপনীত হলেন।
সুলতানুল উলামা (র)-এর নিশাপুর গমন:
নিশাপুরে হযরত খাজা ফরীদুদ্দীন আত্তার (র) সুলতানুল উলামার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তখন মাওলানা জালালউদ্দিন রূমীর বয়স ছিল মাত্র ছয় বৎসর। কিন্তু শৈশবেই তার ললাটে সৌভাগ্য ও বুযুর্গীর লক্ষণ প্রতিভাত হয়েছিল। খাজা ফরীদুদ্দীন আত্তার শেখ বাহারউদ্দীন ওলাদকে বললেন, এই সুযোগ্য রত্নটির প্রতি অবহেলা করবেন না। তিনি স্বরচিত কিতাব “গওহারনামা মাওলানা রূমীকে দান করে বললেনঃ অদূর ভবিষ্যতে এই কিশোর দগ্ধীভূত অন্তরবিশিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে অগ্নি প্রজ্বলিত করে দিবে।
সুলতানুল উলামা মাওলানা বাহাউদ্দীন ওলাদের মুরীদগণের মধ্যে সাইয়্যেদ বুরহানুদ্দীন তিরমিযী তত্ত্বজ্ঞানী এবং উচ্চ শ্রেণীর আলেম ছিলেন। মাওলানা রূমীর পিতা তার শিক্ষা-দীক্ষা ও তরবিয়তের ভার উক্ত সাইয়্যেদ বুরহানুদ্দীনের উপর অর্পণ করেছিলেন। মাওলানা অধিকাংশ বিষয়ের শিক্ষালাভ সাইয়্যেদ সাহেবের নিকট হতে করেছিলেন, আর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন স্বীয় বুযুর্গ পিতার নিকট হতে।
মক্কা মদীনায় সুলতানুল উলামা
মাওলানা রূমীর পিতা সুলতানুল উলামা (র) নিশাপুর হতে বাগদাদে এসে পৌছলেন। কয়েক বছর তথায় অবস্থানের পর হেজায অভিমুখে রওয়ানা হন এবং মক্কা শরীফে উপস্থিত হয়ে হজ্জব্রত পালন করেন। অতঃপর মদীনা শরীফে গিয়ে রওযা পাক জিয়ারত করেন, তদন্তর সিরিয়া হয়ে যানজানে আসেন এবং যানজান হতে কয়েকটি শহর ভ্রমণপূর্বক অবশেষে মালাতিয়া উপস্থিত হন। তথায় আকশহর অঞ্চলে তিনি চার বৎসর অবস্থান করেন এবং দ্বীন শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত থাকেন। অবশেষে কাউনিয়ার অন্তর্গত লারিন্দা এলাকায় গমন করেন।
বিবাহ বন্ধনে মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি:
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির জীবনী এ বিবাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। হিজরী ৬২৩ সনে মাওলানা রুমী (র) সমরকন্দ নিবাসী মাওলানা মরফুদ্দিন সাহেবের কন্যা জাওহার খাতুনের সাথে শুভ পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৯ বৎসর। ঐ বৎসরই মাওলানা প্রথম সন্তান বাহাউদ্দীন সুলতান ওলাদ জন্মগ্রহণ করেন। এই বিবির গর্ভে মাওলানা রূমীর আরও দুইটি সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। মাওলানার তিন জন সন্তানের নামঃ ১. বাহাউদ্দীন মােহাম্মদ সুলতান ওলাদ ২. আলাউদ্দীন মোহাম্মদ ৩. মুযাফফর উদ্দীন।
মাওলানা রুমীর এই পত্নীর ইন্তেকালের পর দ্বিতীয় বিবাহ কেরা খাতুন কাউনাবীর সাথে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিবির গর্ভে একমাত্র কন্যা মালাকা খাতুন জন্মগ্রহণ করেন।
মাওলানা রূমীর পিতার কাউনিয়ায় অবস্থান:
রূমের বাদশাহ আলাউদ্দীন কায়কোবাদের আন্তরিক অনুরোধে মাওলানার পিতা সুলতানুল উলামা (র) ৬২৬ হিজরীতে কাউনিয়া শুভাগমন করেন। মাওলানা রূমীর বয়স তখন ২২ বছর। কাউনিয়ায় বাদশাহ স্বয়ং শাহীমহলের সন্নিকটে ঘোড়া হতে নোম নগ্ন পায়ে অতিশয় বিনয় ও নম্রতার সাথে সুলতানুল উলামাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন।
বাদশাহ শাহী মহলেই মাওলানা সুলতানুল উলামার বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে চাইলে মাওলানা সুলতানুল উলামা বলেন, আমরা এলম পিপাসু লোক, মাদ্রাসায় অবস্থান করা আমাদের পছন্দনীয়। সুতরাং কাউনিয়ার মাদ্রাসায় তিনি অবস্থান করলেন।
সুলতানুল উলামা বাহাউদ্দিন ওলাদের ইন্তেকাল
দুই বৎসরকাল কাউনিয়ায় অবস্থান করার পর ৬২৮ হিজরী সনে মাওলানা রূমীর পিতা মাওলানা বাহাউদ্দীন ওলাদ (রা) সারা বিশ্বকে শোকসাগের ভাসিয়ে ইহকাল ত্যাগ করেন। মাওলানা রূমীর বয়স তখন ২৪ বৎসর।
এ যাবৎ মাওলানা রূমী স্বীয় পিতার সঙ্গেই ছিলেন। তিনি তার নিকট যাহেরী এবং বাতেনী তা অর্জন করতে থাকেন। মাওলানা রূমী ২২ বৎসর বয়সে কাউনিয়ায় উপস্থিত হন। পরবর্তী যুগে এই কাউনিয়া ছিল মাওলানার রুমির স্থায়ী বাসস্থান। পিতার মৃত্যু মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির জীবনী তে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসে।
মাওলানা রুমির জন্য বাদশা কায়কোবাদের মাদ্রাসা স্থাপন
বাদশাহের উজির ও প্রাক্তন গৃহশিক্ষক আমীর বদরুদ্দীন গহরতাশ মাওলানা রূমীর জ্ঞানের গভীরতা এবং খোদাপ্রদত্ত মেধা ও স্মৃতিশক্তির প্রখরতা অবলোকন করে মুগ্ধ হলেন। তিনি মাওলানা রূমীর জন্য একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং প্রচুর সম্পদ এই মাদ্রাসার জন্য ওয়াকফ করে দেন। মাদ্রাসার নাম রাখা হল- মাদ্রাসায়ে খোদাওয়ান্দেগার। সুলতান আলাউদ্দীন কায়কোবাদ মাওলানা রুমীর অতিশয় ভক্ত ছিলেন।
তিনি তাকে অতিশয় সম্মান প্রদর্শন করতেন। কাউনিয়ার দুর্গ নির্মাণের পর মাওলানা রূমীকে উহা
পরিদর্শন করার আহ্বান জানালে মাওলানা বললেন – জল প্রবাহ হতে বাঁচার এবং শত্রু আক্রমণ প্রতিরোধ উত্তম পন্থা ও ব্যবস্থা বটে; কিন্তু নির্যাতিত লোকদের বদ-দোআর তীর হতে রক্ষা পাওয়ার পথ কি? যাহা লক্ষ-কোটি গুম্বদ ও কাঙ্গরু ভেদ করে লক্ষ্যস্থলে পৌছে জগতকে ধ্বংস করে ফেলে।
ন্যায় ও সুবিচারের দুর্গ নির্মাণ করুণ, দ্বীন ও দুনিয়ার শক্তি ও উপকারিতা উহাতে নিহিত আছে। বাদশাহের অন্তরে এই নছীহত রেখাপাত করল। মাওলানার পিতার ইন্তেকালের পর বাদশাহ, পাত্র-মিত্র, উলামা-মাশায়েখ সকলের সম্মিলিত ঐক্যমতে মাওলানা রূমী পিতার স্থলাভিষিক্ত হলেন। শিক্ষা-দীক্ষা, তালীম-তরবীয়তের কাজ পুরাদমে চলতে লাগল।
উস্তাদ সাইয়্যেদ বুরহানুদীনের সাথে মাওলানা রুমির পুনরায় সাক্ষাৎ:
সুলতানুল উলামা বাহাউদ্দিন ওলাদের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে রুমির উস্তাদ বুরহানুদ্দীন সাইয়্যেদ তিরমিয হতে কাউনিয়া গমন করেন। দীর্ঘদিন পর উস্তাদ-শারগেদ একে অন্যের মাঝে আত্মহারা হয়ে পড়েন। নিজেদের আনন্দ বেদনা ভাগাভাগির পর উস্তাদ বুরহানুদ্দীন সাইয়্যেদ মাওলানা রুমির জ্ঞানের গভীরতা পরীক্ষা করতে লাগলেন এবং অনুধাবন করলেন, জালালউদ্দিন রুমি সমস্ত বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করেছেন। তখন তিনি বললেন, এখন শুধু বাতেনী এলম বাকী রয়েছে। উহা তোমার পিতা আমার নিকট আমানত রেখে গিয়েছেন। আমি তোমাকে উহা দান করছি। মাওলানা রুমির পিতার ইন্তেকালের পর তিনি তরিকতের মকাম ও স্তর গুলি সাইয়্যেদ বুরহানুদ্দীন হতে অতিক্রম করেছেন। দীর্ঘ নয় বছর রুমি তাঁর উস্তাদের সাথে থাকার পর হিজ্রী ৬৩৭ সালে উস্তাদ বুরহানুদ্দীন ইন্তেকাল করেন।
উচ্চ শিক্ষার জন্য জালালউদ্দিন রুমির সিরিয়া গমন:
৬৩০ হিজরী সনে ২৪ বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর দুই বছর পর জালালউদ্দিন রুমি জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য সিরিয়া গমন করেন। সেখানে তিনি হালাবিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং ছাত্রাবাসে থেকে মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করতে থাকেন। ছাত্র জীবনেই তিনি সাহিত্য, ফেকাহ, হাদীস, তাফসীর এবং বিজ্ঞান, দর্শন ও তরক-শাস্ত্রে এমন পূর্ণ জ্ঞান ও বুৎপত্তি লাভ করেন। যে কোনো জটিল ও কঠিন মাসয়ালা উপস্থিত হলে তা যদি কেউ সমাধান করতে না পারত, তবে লোকে মাওলানা রুমির নিকট নিয়ে আসত এবং রুমি (র) খুব সহজেই উক্ত সমস্যার সমাধান দিতেন। তিনি এত সুন্দর, নিখুঁত, এবং প্রাঞ্জল ভাষায় হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে বর্ণনা করতেন, যা কিতাবে পাওয়া যেত না।
সিরিয়া হতে রুমির দামেশকে গমন:
হলব হতে মাওলানা রুমি দামেশকে চলে যান। দামেশক ছিল তখনকার আলেম ওলামাও মাশায়েখদের আবাসস্থল। সেখানে রুমি মুকাদ্দেসিয়া মাদ্রাসায় অবস্থান করেন। তিনি শেখ মুহীউদ্দিন ইবনে আরবী, শেখ ওসমান রুমী, শেখ ছদরুদ্দীন কাউনাবী প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত আলেম ও মাশায়েখে কেরামের সাথে থেকে পরস্পর তরীকত, মা’রেফতের গুপ্ত রহস্য ও গুঢ়তত্ত্ব সমন্ধে আলোচনা করতেন।
মাওলানা রুমির কাউনিয়া প্রত্যাবর্তন:
৬৩৪ কিংবা ৬৩৫ হিজরীতে মাওলানা রুমি স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে দামেশকে হতে পুনরায় কাউনিয়ায় আগমন করেন। উস্তাদ সাইয়্যেদে বুরহানুদ্দীন (র) এর ইন্তেকালের ৫ বছর পর অর্থাৎ ৬৪২ হিজরী পর্যন্ত মাওলানা যাহেরী আলেমের বেশে কালাতিপাত করতে থাকেন। শিক্ষাদান, তালীম, তবিয়ত, ওয়াজ,নছীহত, ফতওয়া লেখা ইতযাদি কাজে পুরোপুরি নিয়োজিত ছিলেন। গজল ও কাওয়ালী শ্রবণ হতে পুরোপুরি দূরে থাকতেন। মোটকথা যাহেরি আলেমের প্রভাবই ছিল প্রবল। তাঁর এই অবস্থা ৬৪৩ হিজরি পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এর পর রুমীর জীবনে বিরাট পরিবর্তন দেখা দিলো। আর এই পরিবর্তন নিয়ে আসলো অনন্তর শামসে তাবরিযীর সাক্ষাৎ লাভ। মাওলানা রুমি নিজেই বলেছেন-
“সমগ্র রুমের অধিবাসী রাজা, বাদশাহ, ধনী, বণিক, উলামা, মাশায়েখ, এবং আমীর-উমারা যতদিন জালালউদ্দিনের গোলাম ছিল, ততদিন জালালউদ্দিন ছিল মৌলবী জালালউদ্দিন কাউনাবী, কিন্তু যেদিন ক্রীতদাসরূপে নিজেকে শামসে তাবরিযীর চরণে লুটিয়ে দিলাম, সেদিন হতে আমার হল মাওলায়ে রু্ম।
শামসে তাবরিজি ও জালালউদ্দিন রুমির সাক্ষাৎ, জালালউদ্দিন রুমির জীবনী তে গুরুত্ববহ ঘটনা:
আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী শামস তাবরিজি একজন ইরানী সুফী ব্যক্তিত্ব। তাঁকে জালালউদ্দিন মুহাম্মদ রুমির আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবেও মানা হয়ে থাকে। শামস তাবরিজি হন্যে হয়ে চারদিকে একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু ও মুরশিদ খুঁজতেছিলেন। ঘটনাক্রমে তিনি রুমির কথা জানতে পারেন। কাউনিয়ায় পৌছে শক্কর ব্যবসায়ী (হালওয়ায়ী)-এর সরাইখানায় উপস্থিত হলেন।
এদিকে মাওলানা রুমি (র) কাশফের সাহায্যে তাবরিজি (র)-এর কাউনিয়ায় আগমন-সংবাদ জানতে পেরে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সঙ্গে চলল আলেম, তালেবে এলম, মুরীদ-ভক্তদের বিরাট দল। সারা পথে লোকেরা তাঁর কদমবুসী করতে লাগল, এই অবস্থায় তিনি সরাইখানায় উপস্থিত হলেন। শামসে তাবরিজি জালালউদ্দিন রূমিকে দেখা মাত্রই বুঝতে পারলেন যে, ইনিই সেই ব্যক্তি যার সম্বন্ধে গায়েব হতে শুভ-সংবাদ প্রদান করা হয়েছিল।
উভয় বুজুর্গের চারি চক্ষু মিলিত হলে অনেকক্ষণ পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে নীরব ভাষায় কথাবার্তা চলতে থাকল। অতঃপর প্রথমে শামস তাবরজি মাওলানা রুমিকে জিজ্ঞেস করলেন, “হযরতবায়েজিদ বোস্তামীর এই দুটি পরস্পর বিরোধী অবস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য কেমন করে হতে পারে? এক দিকে তাঁর অবস্থা এরূপ ছিল যে, হুজুর(স) কিরূপে খরবু্জা আহার করেছিলেন তা না জানার কারণে তিনি আজীবন খরব ভক্ষণ করেন নি। অপর দিকে তিনি নিজের সম্বন্ধে এইরূপ উক্তি করতেন।
“ইয়া আল্লাহ; আমার শান কত বড়!’ অথচ রাসুলুল্লাহ (স) এত বড় বুজুর্গ নবী হয়ে বলতেন- আমি সারা দিনের মধ্যে ৭০ বার ইস্তেগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করে থাকি।
মাওলানা রুমি(র) তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, বায়েজিদ বোস্তামী(র) যদিও অতি উচ্চ শ্রেণীর বুযুর্গ ছিলেন, কিন্তু অলিত্বের পথে তিনি এক নির্দিষ্ট মকামে পৌছে থেমে গেলেন। পক্ষান্তরে হযরত রাসুলুল্লাহ (স) আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যলাভের পথে এক স্তর হতে অন্য স্তরে ক্রমশঃ উন্নতি করতেছিলেন। সুতরাং যখন উন্নত স্তরে পৌছতেন, তখন নিম্নস্তরের প্রতি লক্ষ্য করে উহাকে এত ত্রুটিপূর্ণ দেখতে পেতেন যে, উহার জন্য আল্লাহ তা’আলার দরবারে ইস্তেগফার করতে থাকেন।”
আবার কেউ কেউ সাক্ষাতের প্রথম-পর্ব নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেন যে, একদিন মাওলানা জালালউদ্দিন মুহাম্মদ রূমি শাহী জাকজমকের সাথে বাহনে আরূঢ় অবস্থায় কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে শামস তাবরিজি সম্মুখে অগ্রসর হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “সাধ্য-সাধনা, জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য কি?” মাওলানা উত্তর দিলেন, “শরীয়তের বিধি-বিধান, আহকাম-আরকান সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করা।” শামস তাবরিজি বললেন, “না, না, উদ্দেশ্য এই যে, যার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা হচ্ছে তার সান্নিধ্যে উপনীত হওয়া।” অতঃপর হাকীম সানাঈর এই বয়েত আবৃত্তি করলেনঃ
“যেই এলম তোমাকে তোমা হতে ছিনিয়ে নিয়ে তার ক্রোড়ে ধারণ না করে, ঐ এলম হতে অজ্ঞতা শত গুণে ভাল।”
ইহা শোনামাত্র মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির জীবনী তে মোড় ঘু্রে গেল।
আবার কোন কোন জীবনী লেখক সাক্ষাৎ-পর্বের সাথে ঘটনাবলী বর্ণনা করেছেন। মাওলানা রুমি (র) শাসস তাবরিজির খেদমতে প্রথমে উপস্থিত হন নাই; বরং স্বয়ং মাওলানা শামসই মাওলানা রূমীর খেদমতে হাজির হয়েছিলেন। মাওলানা স্বীয় বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। আর চারপাশে জ্ঞানান্বেষী ছাত্রদের ভীড়, আশেপাশে রাশি রাশি কিতাব বিরাট বিরাট স্তুপাকারে রক্ষিত।
হঠাৎ শামস তাবরিজি (র) তথায় উপস্থিত হয়ে সালামান্তে ছাত্রদের সাথে মিশে বসে গেলেন। কিয়ৎকাল চুপ থাকার পর কিতাবরাশির দিকে ইশারা করে জিজ্ঞাসা করলেন, “ইহা কি জিনিস?” মাওলানা উত্তর করলেন, “ইহা ঐ বস্তু, যা তুমি জান না।”
একথা বলার সাথে সাথেই কিতাবসমূহে আগুন লেগে গেল, দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকল। এতদ্দর্শনে মাওলানা হতবাক হয়ে শামসকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ইহা কি ব্যাপার? শামস উত্তর দিলেন, “ইহা ঐ ব্যাপার যা তুমি জান না।”
অন্য আর একটি বর্ণনায় আছে যে, একদিন মাওলানা রূমি একটি হাওযের কিনারায় বসে আছেন। সম্মুখে কতিপয় কিতাব রক্ষিত ছিল। হযরত শামস (র) প্রশ্ন করলেন, “এগুলি কি?” মাওলানা উত্তরে বললেন, “ইহা বিজ্ঞান দর্শনের কথোপকথন, এগুলিতে তোমার কি মতলব?” হযরত ইহা শ্রবণমাত্র তৎক্ষণাৎ কিতাবগুলিকে হাওযের মধ্যে নিক্ষেপ করে দিলেন।
এতে মাওলানা রূ্মিরর অন্তরে ভীষণ আঘাত লাগল। শামস তাবরিজিকে (র) উদ্দেশ্য করে বললেন, “ওহে দরবেশ ! তুমি এমন সম্পদ বিনষ্ট করেছ, যা এখন আর কোথাও পাওয়া যাবে না। এই কিতাবগুলিতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন সূক্ষতত্ত্ব লিপিবদ্ধ ছিল, যার বিনিময় দুষ্প্রাপ্য।”
ইহা শুনে শামস হাওযের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে সমস্ত কিতাব হাওযের মধ্য হতে উঠিয়ে কিনারায় রাখলেন । সমুদয় কিতাৰ পর্বের ন্যায় সম্পূর্ণ শুষ্ক ছিল, আর্দ্রতার লেশমাত্রও তাতে ছিল না। এতে মাওলানা রুমি অতিশয় আশ্চর্যান্বিত হলেন।
শামস তাবরিজি(র) বললেন, ইহা বাস্তব জগতের অবস্থাসমূহের বিষয়বস্তু, তুমি ইহা কি বুঝবে?
মাওলানা রূমীর সাধনা:
মাওলানা রূমীর একজন সুযোগ্য শাগরেদ সিপাহসালার ছিল। তিনি ৪০ বছর মাওলানা রুমির খেদমত করেছেন। তিনি বলেন, শামসের সাথে সাক্ষাৎ লাভের পর মাওলানা স্বীয় বাসস্থান বর্জনপূর্বক শামস তাবরিজির নিকট অবস্থান করতে লাগলেন। এমন কি, একাধারে ছয় মাস মতান্তরে তিন মাস সালাহুদ্দীন স্বর্ণকারের হুজরায় চিল্লাকাশী করেছেন।
এশকে এলাহীর অমৃত সুধা এবং মহব্বতে এলাহীর প্রাচুর্যের রূহানী খোরাক শামসকে বাহ্য খাওয়া-দাওয়া হতে একেবারে বেপরোয়া করে দিয়েছিল। একাধারে বহু দিন পর্যন্ত কিছু পানাহার করতেন না। কোন কোন সময় কয়েক সপ্তাহ আত্মহারা অবস্থায় বিভোর থাকতেন। প্রকৃতিস্থ হওয়ার পর দৈহিক শক্তি অক্ষুন্ন রাখার জন্য দুই-একটি রুটি পানিতে ভিজিয়ে আহার করতেন। শামস তাবরিজির সাহচর্য লাভ করে মাওলানা রূমীর অবস্থাও তদ্রুপ হয়ে গিয়েছিল ।
চিল্লাকশীর এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তারা উভয়ে কোন প্রকার খাদ্য-দ্রব্য স্পর্শ করেন নাই। স্বর্ণকার সালাহুদ্দীন ব্যতীত তাদের নিকট কেউ যেতে পারত না।
এই সময় হতে মাওলানা রুমির মধ্যে এক বিশেষ পরিবর্তন দেখা গেল যে, যেখানে তিনি গযল-কাওয়ালী শ্রবণ হতে দূরে থাকতেন, সেখানে এখন তিনি এশকে এলাহীর প্রেম গাঁথা শ্রবণ না করলে শান্তি পেতেন না। শিক্ষকতা, ওয়ায-নছীহত করা এবং ফতওয়া লেখার কাজ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেল। মাওলানা জালালউদ্দিন রূমী এবং শামস তাবরিজির মধ্যে এমন ঘনিষ্ঠতা ও প্রগাঢ় মহব্বত জন্মাল যে, একে অপরকে ব্যতীত একদণ্ডও কাটাতে পারতেন না। একজন অপরজন ব্যতীত কিছুতেই স্বস্তি লাভ করতে পারতেন না। সমগ্র শহরে এই রব পড়ে গেল, কোথা হতে এক ভবঘুরে পাগল এসে মাওলানার উপর এমন জাদু করেছে, যাতে এখন মাওলানা একেবারে অকর্মণ্য হয়ে পড়েছেন।
মাওলানা যখন প্রত্যেক কাজে শামস তাবরিযীর অনুসরণ করতে লাগলেন এবং ক্রমে ক্রমে যাহেরী এলম ও পার্থিবতার সাথে যাবতীয় সম্পর্ক চ্ছেদ হতে লাগল, তখন এই ব্যাপারটি মাওলানার শাগরেদ, মুরীদ ও ভক্তদের অন্তরে বিরাট আঘাত হানল। এই অসন্তোষের সাথে সাথে তারা আশ্চর্যবোধ করতে লাগল।
কেননা, শামস তাবরিজির হাল-হাকীকত তাদের জানা ছিল না। মুরীদ-ভক্তগণ মনে মনে ভাবছিলেন, আমাদের জীবন মাওলানার খেদমতে কাটল, মাওলানা, কাশফ-কারামত প্রত্যক্ষ করেছে, দেশ-বিদেশের সর্বত্র মাওলানার যশ-খ্যাতি ছড়িয়ে আছে। এমতাবস্থায় নাম-ধামবিহীন কোথাকার এক লোক এসে মাওলানাকে সবকিছু হতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। এখন তার চেহারা দর্শনও আমাদের ভাগ্যে জোটে না। শিক্ষাদান, ওয়ায-নছীহত করা, ফতওয়া দেয়া একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই এই ব্যক্তি কোন জাদুকর বা বিরাট ধুরন্ধর লোক হবে। নতুবা কার সাধ্য যে, পর্বততুল্য মহামানবকে একটি তৃণের ন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
শামস তাবরিজির অন্তর্ধান, লোকচুক্ষুর আড়ালে যাওয়া:
মোট কথা, সকলে শামস তাবরিজির শত্রু হয়ে দাড়াল। মাওলানার সম্মুখে তাকে কেউ কিছু বলতে বা করার সাহস পেত না কিন্তু এখানে-ওখানে দেখা পেলে তাকে উত্ত্যক্ত করত, শাসাইত, ভাল-মন্দ বলত, সকলে দিন-রাত এই চিন্তা করত- কিরূপে শামসকে এই স্থান হতে বিতাড়িত করা যায়। যাতে আমরা আবার পূর্বের ন্যায় মাওলানা জালাওলউদ্দিন রুমির সাহচর্যে এসে ফয়েয লাভ করতে পারি।
হযরত শামস তাবরিজি (র) লোকেদের বেআদবী বরদাশত করছিলেন। ভাবতেন, মাওলানা রুমির প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার অতিশয্যের কারণে ইহাদের মনে ব্যথা। কিন্তু ব্যাপার যখন সীমা অতিক্রম করে চলল, তখন তিনি একদিন চুপিচুপি কাউনিয়া হতে (বৃহস্পতিবার ১লা শাওয়াল ৬৪৩ হিজরী) চলে গেলেন।
শামস তাবরিজির বিচ্ছেদ মাওলানা রূমীর অন্তরে ভীষণ আঘাত করেছিল, হিতে বিপরীত হল । মুরীদগণ যা ভেবেছিল, ফল হল তার একেবারে উল্টো। ভেবেছিল, শামস চলে গেলে মাওলানা ভক্ত ও মুরীদগণের প্রতি মনোনিবেশ করবেন। কিন্তু শামস তাবরিজি চলে যাওয়া, তার বিচ্ছেদে মাওলানা এত কাতর ও ব্যথিত হয়ে পড়লেন যে, সমস্ত মানুষ হতে সর্বপ্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে নির্জনতা অবলম্বন করলেন। মুরীদগণের প্রতি অল্প-বিস্তর যতটুকু লক্ষ্য ছিল, উহাও বিলুপ্ত হল । ঐ দুর্বলমনা ভক্তদের কারণে সত্যিকারে ঘনিষ্ঠ সহচরগণও সাহচর্য হতে বঞ্চিত হলেন।
এই নির্জন বসতিকালে মাওলানা রূমি বিরহ-ব্যথায় হৃদয়বিদারক বহু কবিতা লিখে ফেললেন। যারা শামস তাবরিজির মনে দুঃখ প্রদান করেছিল, সকলে সমবেতভাবে মাওলানা রুমির খেদমতে এসে ক্ষমা প্রার্থনা করল।
মাওলানা রূমীর বিশিষ্ট খাদেম সিপাহসালার বলেন, মাওলানা সর্বতোভাবে সকলের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে নির্জনবাস করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ দামেশক হতে শামসে তাবরিজির তরফ হতে জালালউদ্দিন মুহাম্মদ রুমির নামে এক পত্র আসল। এই পত্র পেয়ে মাওলানার অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হল । শামস তাবরিজির এশক ও মহব্বতের গজল-গাঁথার প্রতি আকৃষ্ট হলেন এবং যারা শামসের সাথে বেআদবী করেনি, তাদের প্রতি পূর্বের ন্যায় কৃপাদৃষ্টি করতে লাগলেন।
হযরত শামস তাবরিজির খেদমতে মাওলানা শওক ও মহব্বত সম্বলিত হৃদয়বিদারক ছন্দোবদ্ধ। চারখানা চিঠি লিখলেন, যাতে নিজের হাল- অবস্থা এবং সাক্ষালাভের অদম্য আকাঙ্খা ও পেরেশানীর কাহিনী উল্লেখ ছিল। প্রথম চিঠির দুইটি পঙক্তি এইঃ
“হে অন্তরের আলো শীঘ্র আসুন! হে এশক ও বাঞ্ছিতের চরম শিখর, জলদি আসুন।”
মাওলানা রূমি যৎকিঞ্চিৎ শান্ত হলেন। হট্টগোল কিছুটা প্রশমিত হল। লোকজন শামস তাবরিজির বিরোধিতা ত্যাগ করল। মাওলানা রূমী কাউনিয়া প্রত্যাবর্তনের বিষয় চিন্তা করতে লাগলেন।
শামস তাবরিজির পুনরায় কাউনিয়ায় উপস্থিতি:
শামসের বিচ্ছেদে মাওলানা হৃদয়বিদারক প্রেম-গাঁথা শুনে ভক্তগণও চিন্তা করতেছিলেন, কিরূপে শামসকে আবার কাউনিয়ায় আনয়ন করা যায় এবং মাওলানার পেরেশানী লাঘব করা সম্ভব হয়। সুতরাং স্থির করা হল, কাউনিয়া হতে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের মধ্য হতে একটি বিশিষ্ট দল শামসের খেদমতে পৌছে অনুনয়-বিনয় করে যেরূপেই হউক তাঁকে কাউনিয়ায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এই দলের নেতৃত্ব করবেন মাওলানা রূমীর জ্যৈষ্ঠ পুত্র সুলতান ওলাদ। পরামর্শের পর সকলে তাদের সংকল্প মাওলানার খেদমতে পেশ করলেন। এটা শুনে মাওলানা অতিশয় সন্তুষ্ট হলেন এবং তৎক্ষণাৎ শামসের নামে ছন্দকারে এক চিঠি লেখেন।
চিঠির সারমর্ম এইঃ “আমার ঐ অপরূপ প্রিয়তমকে এখনই আমার নিকটে ফিরিয়ে আন, যাতে আমার চতুর্দিকে আচ্ছন্ন অন্ধকার, অপসারিত হয়ে যায়। মধূময় ছলনায়ই হোক কিংবা মিষ্টিমধুর সম্ভাষণেই হোক তাকে আমার সমীপে আনয়ন কর, ইত্যাদি।
অতঃপর এক সহস্র স্বর্ণমুদা সুলতান ওলাদের হাতে দিয়ে বললেন, এই দীনার আর আমার এই পত্র তার খেদমতে পেশ করবে। সাত সদস্যবিশিষ্ট এই কাফেলা মাওলানা সুলতান ওলাদের নেতৃত্বে দামেশক অভিমুখে রওয়ানা হল । তথায় পৌছে শামসের অনুসন্ধান করতে লাগল। ওদিকে হযরত শামস তবরিজি লোকালয় হতে দূরে থেকে মুরাকাবা করা পছন্দ করতেন। কাজেই তাকে বের করা তত সহজ ছিল না।
মোটকথা, কাউনিয়ার এই কাফেলা দামেশকে উপস্থিত হয়ে অনুসন্ধান করতে লাগলেন। বিভিন্ন স্থান তালাশের পর অবশেষে একটি সরাইখানায় গিয়ে দেখতে পেলেন, তিনি একটি বালকের সাথে পাশা খেলছিলেন। বালকটি আল্লাহ তা’য়ালার মকবুল বান্দা। কিন্তু বালকটি নিজের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবহিত ছিল না। কিন্তু শামস তাবরিযী (র) তার আভ্যন্তরীণ অবস্থা অবগত হয়েছিলেন । অধিকাংশ সময় ঐ বালকটির সাথে পাশা খেলতেন।
খেলা সমাপ্ত হওয়ার পর দলের নেতা সুলতান ওলাদ শামস তাবরিজির পদযুগল জড়ায়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। হযরত শামস সুলতান ওলাদকে চিনতে পারলেন। তাঁকে উঠিয়ে গলায় জড়িয়ে ধরে তার ললাটে চুম্বন করলেন। অতঃপর মাওলানা রূমীর অবস্থা জিজ্ঞাসা করলেন।
সুলতান ওলাদ মাওলানার পুত্র এবং নজনাস্বরূপ দেয়া দীনারগুলি তাঁর পদপ্রান্তে রেখে দিলেন। আর কাফেলার অপর সকলে মিনতি সহকারে নিজেদের অন্যায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করল।
মাওলানা শামস স্বর্ণমুদ্রাগুলি দেখে মৃদু হেসে বললেন- “চতুর পাখি কখনও শীষের লোভে ফাঁদে পড়ে না।” অতঃপর বললেন, এই চাড়া খণ্ডের কোন প্রয়োজন নাই। মাওলানার চিঠি ও খবরই যথেষ্ট। হযরত শামস কাফেলার সকলকে মেহমানস্বরূপ রাখলেন এবং অতিশয় আদর ও যত্ন করলেন। তারপর সকলকে নিয়ে দামেশক অভিমুখে রওয়ানা হলেন। কাফেলার সকলে বাহনে আরূঢ় ছিল, কিন্তু সুলতান ওলাদ আদব রক্ষার্থে শামস তাবরিজির বাহনের পাদানি বরাবর থেকে পদব্রজে চলছিলেন। কাউনিয়া পর্যন্ত এইরূপে পায়ে হেটে আসছেন।
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী (র) শামসের আগমনবার্তা অবগত হয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন । তিনি অতিশয় আগ্রহের সাথে তার প্রতীক্ষায় ছিলেন।
শামস কাউনিয়ায় উপস্থিত হলে মাওলানা রুমি:
সকল মুরীদ ও ভক্তবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের জন্যে শহরের বাইরে অগ্রসর হয়ে মহা ধুমধামের সাথে তাকে শহরে নিয়ে আসলেন।
কয়েক মাস বিচ্ছেদ যাতনা ভোগ করার পর আকাঙ্ক্ষিত সুখের দিনের নাগাল পেলেন। উভয়ে মহা আনন্দে কালাতিপাত করতে লাগলেন। মাওলানা রূ্মি যেহেতু শামসকে অত্যন্ত ভালবাসত, কিছুক্ষণের বিচ্ছেদও বরদাশত করতে পারত না। সুতরাং মাওলানা রূমির স্নেহে প্রতিপালিতা এক সুশ্রী রমণী কিমইয়া বেগমের সাথে হযরত শামস তাবরিজির বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল মাওলানা রূমীর বাড়ির সম্মুখে নব-দম্পতির বসবাসের ব্যবস্থা করে দেয়া হল।
শামসের পুনরায় নিরুদ্দেশ যাত্রা বা হত্যা, জালালউদ্দিন রুমির জীবনী তে গুরুত্বপূর্ণ বিচ্ছেদ:
এই দিকে মাওলানা জালালউদ্দিন রূমির পুত্র আলাউদ্দীন চালপী শামস তাবরিযীকে সুনজরে দেখত না। শামসকে উত্ত্যক্ত ও বিরক্ত করার উদ্দেশ্যে তাঁবুর ভিতর দিয়ে মাওলানার বাড়ি যাতায়ত করত। যদিও বাড়িতে ঢুকবার অন্য পথও ছিল, কিন্তু শামসকে পেরেশান করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। হযরত শামস (র) তাকে নম্রভাবে বারবার নিষেধ করতেন, কিন্তু আলাউদ্দীন চালপী বিরত থাকাতো দূরের কথা ; বরং শামসের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। কিছুসংখ্যক সন্ত্রাসবাদী লোকও জুটে গেল । আলাউদ্দীন চালপী তার সাথে কিছু লোক ভিড়াতে সক্ষম হল।
অন্য দিকে মাওলানা রূমীর কিছুসংখ্যক মুরীদ ও ভক্তের দল যখন দেখল যে, শামস তাবরিজির দ্বিতীয়বার প্রত্যাবর্তনের পর মাওলানা এলমী মজলিসে যোগদানের পরিবর্তে শামসের সায় থেকে শুধু এশকে এলাহীর প্রেমালাপ ও প্রেমগাথা শ্রবণ করতে থাকেন; সুতরাং তাদের অন্তরে শামসের প্রতি বিদ্বেষভাব জেগে উঠল।
অবশেষে তাদের বিদ্বেষভাব এতদূর অগ্রসর হল যে, তারা শামসকে হত্যা করে মাওলানা রূমীকে জাদুগর শামসের পাণ্ডা হতে চিরতরে মুক্ত করার ফন্দি করল। এই দলের লোকসংখ্যা ছিল সাত জন। একদিন তারা সাত জন অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে সকলে মিলে এ কাজ সম্পন্ন করার জন্য মাওলানা রূমি (র) এবং শামস (র) সাধারণতঃ যে কামরায় অবস্থান করতেন, সেই কামরার দিকে অগ্রসর হল । তাদের মধ্য হতে একজন কামরার দিকে অগ্রসর হল । আর অবশিষ্ট ছয় জন গোপনে লুকিয়ে রইল। ঐ সাতজনের মধ্যে মাওলানার মধ্যম পুত্র আলাউদ্দীন মোহাম্মদও ছিল। |
মোটকথা, তাদের মধ্যে একজন কামরার দরজার সম্মুখে যেয়ে হযরত শামসকে হাতের ইশারায় বাহিরে ডাকল । হযরত শামস কামরার বাইরে আসার সাথে সাথে হত্যাকারীর দল ছোরা দ্বারা শামসের উপর আক্রমণ করল। শামস আঘাত প্রাপ্ত হয়ে এক হাঁক মারলেন । হাঁক শুনে শামস তাবরিজির হত্যাকারী দল মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেল। তাদের জ্ঞান ফিরে আসলে দেখতে পেল যে, কয়েক ফোটা রক্ত সেখানে পড়ে আছে আর কিছুই নেই।
এ দুর্ঘটনা ৬৪৫ হিজরীর কোন এক বৃহস্পতিবার সংঘটিত হয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, হাঁক মেরে মাওলানা শামস তাবরিজি কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। আবার কেউ বলেন, তাঁকে হত্যা করে হত্যাকারীগণ মাওলানা রুমির পিতা হযরত বাহাউদ্দীনের মাজারের নিকট দাফন করে রেখেছিল। মাওলানা রূমি যখন পরদিন ভোরে মাদ্রাসায় আসলেন এবং শামসকে বাড়িতে দেখলেন না, তখন হু-হুতাশ করতে লাগলেন। নির্জন কক্ষে যেয়ে সুলতান ওলাদকে ডাকলেন ? বাহাউদ্দীন ? এখনও ঘুমে? উঠ, মুরশিদের অনুসন্ধান কর। অনুভূতিশক্তিকে তাঁর কৃপা । সৌরভ হতে একেবারে শূন্য অনুভব করতেছে।
দুই-তিন দিন পর্যন্ত চারিদিকে অনুসন্ধান করলেন, কিন্তু কোথাও শামসের খোঁজ পাওয়া গেল না। এবার শামসের বিয়োগ-ব্যথায় মাওলানা রুমির অবস্থার পূর্বের তুলনায় আরো অবনতি ঘটল । সকলের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে শুধু বিচ্ছেদ-গাঁথা গাইতেন ও কবিতা আবৃত্তি করতেন। মাদ্রাসায় ঘোরাফিরা করতেন। আবার কখনও নির্জনে বসে বিরহ-ব্যথায় মর্মবিদারক কবিতা লিখতেন।
শামসের অন্তর্ধানের পর তার মহব্বতে রূমীর এমন অবস্থা হল যে, যদি কেউ মিছামিছি বলত যে, শামসুদ্দীনকে অমুক স্থানে দেখা গেছে, তিনি তৎক্ষণাৎ পরিধেয় বস্ত্র খুলে তাকে দান করতেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। মাওলানা এহেন মহব্বতের জোশে দেশ ভ্রমণের ইচ্ছা করলেন। অনন্তর শাম দেশের দিকে রওয়া হলেন; কিছুসংখ্যক সহচর সঙ্গে চলল। তথা হতে দামেশকে গেলেন, সেখানেও লোকদের অন্তরে এশকে এলাহীর অগ্নি প্রজ্বলিত করে চললেন।
যখন দামেশকেও কোন খোজ পেলেন না, তখন বললেন, আমি এবং শামস দুই জন নই। তিনি যদি সূর্য হন, তবে আমি তার কিরণ। তিনি যদি সমুদ্র হন, তবে আমি তাঁর বারি-বিন্দু। কিরণের উৎপত্তি সূর্য হতে, বিন্দুর আর্দ্রতা সমুদ্র হতে উদ্ভূত। অতএব, পার্থক্য কিসের? কিছুদিন পর সিরিয়া হতে কাউনিয়ায় প্রত্যাবর্তন করলেন।
কাউনিয়ায় কিছুদিন অবস্থানের পর শামস-এর এশক ও মহব্বতের আগুন আবার জ্বলে উঠল । কিছুসংখ্যক লোকসহ মাওলানা রুমি পুনরায় দামেশকে গমন করেন এবং তথা হতে কাউনিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন। মাওলানা কিন্তু এবার এই ধারণা নিয়ে এলেন যে, আমি নিজেই শামস। শামস-এর অন্বেষণ প্রকৃতপক্ষে নিজেরই অন্বেষণ ছিল । এবার নিজের সন্ধান পেলেন যে, শামস-এর মধ্যে যা কিছু ছিল, তাতো আমার মধ্যে ও আছে। (শামস ছিল এশকে এলাহীর ভাট্টি, আমিও তো তাই।)
এবার দামেশক হতে প্রত্যাগমন করার পর শামস-প্রাপ্তির ব্যাপারে একেবারে নিরাশ হলেন; কিন্তু যে হাল ও অবস্থা শামসের মধ্যে অনুভব করতেন, উহা নিজের মধ্যে অনুভব করতে লাগলেন। শামসের ন্যায় মাওলানা রূমীকেও এশকে এলাহীর অগ্নিকুণ্ড প্রতীয়মান হতে লাগল ।
মাওলানা (র) অধিকাংশ সময় ভাব-সাগরে নিমগ্ন থাকতেন। অনেক সময় ভাবাবেগে অকস্মাৎ বসা হতে দাড়িয়ে হেলতে-দুলতে আরম্ভ করতেন। কোন কোন সময় লোক-সমাজ হতে অদৃশ্য হয়ে থাকতেন। লোকেরা তাঁকে চতুর্দিকে খোঁজাখুঁজি করত। শেষ পর্যন্ত তাকে কোন জনমানবশূন্য পোড়া বাড়িতে পাওয়া যেত।
শেখ সালাহ উদ্দিন এর সহিত সাক্ষাৎ, মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির জীবনী তে নতুন অধ্যায়:
একদিন মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (র) এমনি ভাবাবেগের অবস্থায় বাড়ী হতে বের হয়ে পড়লেন। পথিমধ্যে শেখ সালাহুদ্দীন স্বর্ণকারের দোকান পড়ল। ইনি একজন মহা পূণ্যবান বুযুর্গ এবং মাওলানা রূমীর পীর-ভাই সাইয়্যেদ বুরহানুদ্দীনের মুরীদ ছিলেন। যখন মাওলানা রূমী এবং শামস তাবরিযী নির্জনে চিল্লাকাশী করতেন, তখন একমাত্র এই শেখ সালাহ উদ্দিন স্বর্ণকারই তাদের নিকট গমন করতে পারতেন, অন্য কেউ নয়। তিনি স্বর্ণকারের ব্যবসা করতেন। ঘটনাক্রমে সেদিন তিনি চাদির তবক তৈরী করছিলেন। হাতুড়ীর শব্দে মাওলানার হৃদয়ে প্রেমা গাথার সৃষ্টি হল, তিনি তখন ভাবাবেগে বিভোর হয়ে দণ্ডায়মান রইলেন।
এমতাবস্থা দর্শনে শেখ সালাহ উদ্দিন চাদির উপর অনবরত হাতুড়ীর আঘাত করতে লাগলেন, যদ্দরুন বহু চাদি বিনষ্ট হয়ে গেল, কিন্তু হস্ত সংবরণ করতে সক্ষম হলেন না। অবশেষে মাওলানা তাঁকে আলিঙ্গন করে ভাবাবেগে বিভোর হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ।
এই বয়েতটি আবৃত্তি করতে থাকলেনঃ- “এই স্বর্ণকারের দোকান হতে একটি রত্নভাণ্ডার প্রকাশিত হল; উত্তম সূরত, উত্তম হাকীকত; তাহা কি সুন্দর; কি সুন্দর!!”
সালাহ উদ্দিনকে পেয়ে হযরত শামস-এর বিচ্ছেদ-যাতনার কিছুটা উপশম হল।
এদিকে সালাহ উদ্দিন স্বর্ণকারও দোকান-পাট বিলিয়ে দিয়ে মাওলানার অন্তরঙ্গ বন্ধু সেজে সংসার-ত্যাগী হয়ে গেলেন। মাওলানা রূমি যেই দৃষ্টিতে শামসকে দেখতেন, অবিকল সেই চোখে সালাহ উদ্দিনকেও দেখতে লাগলেন। সেই একাত্মতা, সেই অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব হেতু তাকে না দেখে এক দণ্ডও স্থির থাকতে পারেন না।
শেখ সালাহ উদ্দিন কাউনিয়ার নিকটবর্তী একটি গ্রামের বাসিন্দা। গরীব মাতা-পিতার সন্তান। পিতা মৎস শিকার করতেন। মৎস্য বিক্রয় করে কোন রকমে সংসার চালাতেন। শেখ সালাহ উদ্দিন স্বর্ণকারের পেশা অবলম্বন করেছিলেন। তিনি জীবনের প্রথমাবস্থা হতে আমানত ও দিয়ানতদারীতে খ্যাত। সাইয়্যেদ বুরহানুদ্দীন যখন কাউনিয়ায় আসেন তখন তাঁর নিকট মুরীদ হন। ৬৩৭ হিজরীতে মাওলানা সাইয়্যেদ বুরহানুদ্দীনের মৃত্যুর পর মাওলানা রুমির হাতে পুনরায় বাআত হন।
মাওলানা রূমী শেখ সালাহ উদ্দিনের সাহচর্য অবলম্বন করে কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। হযরত শামসের ন্যায় তার সাথেও গোপন ভেদ ও গুপ্ত রহস্য আদান-প্রদানের সম্পর্ক গড়ে উঠল।
বস্তুতঃ হযরত শামস তাবরিজির সহচর্যে মাওলানা রূমির অন্তর এশকে এলাহীর অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছিল। অবশ্য বিকশিত হওয়ার জন্য দৃশ্যপটের প্রয়োজন ছিল। শামসের জীবদ্দশায় উভয় একে অপরের পটভূমি ছিল। শামসের তিরোধনের পর তিনি শেখ সালাহুদ্দীনকে বেছে নিলেন। কেননা, টর্চলাইটের আলো যেমন শূণ্যস্থানে প্রকাশ পায় না, তদ্রুপ হৃদয়ের আলো বিকশিত হওয়ার জন্য পদরি প্রয়োজন।
সালাহ উদ্দিন এবং রূমীর অন্তরঙ্গতা দর্শনে আত্মীয়-স্বজন, মুরীদ ও ভক্তগণের অন্তরে আবার ক্রোধানল জ্বলে উঠল এবং কানাঘুষা চলতে থাকল যে, শামসই ভাল ছিল, অন্ততঃ সে তো আলেম ছিল, সালাহ উদ্দিনতো আমাদের এখানকার একজন স্বর্ণকার। সারা জীবন চাদির পাত বনিয়েছে সুতরাং শামসের ন্যায় এর অন্তরেও আঘাত হানার চেষ্টা চলতে লাগল । অবশেষে তারা ভাবল, এই ব্যবস্থায় তার সহিত মাওলানার সম্পর্ক শিথিল হবে না। সুতরাং তারা এই সংকল্প বর্জন করল।
মাওলানা দশ বৎসর তাঁর সাহচর্য লাভ করার পর শেখ সালাহ উদ্দিন হঠাৎ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন, তিন-চার দিন পর ৬৫৭ হিজরীর ১লা মহরম শেখ সালাহ উদ্দিন পরলোক গমন করেন। মাওলানা অতি সম্মানের সহিত স্বীয় পিতার মাজারের নিকট তাঁকে সমাহিত করেন।
হুসামুদ্দীন চালপীর সাহচর্য এবং রুমির বন্ধুত্ব:
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির জীবনী তে আবার বন্ধুর বিয়োগ ঘটলো। মুরীদ ও বন্ধু শেখ সালাহুদ্দীন স্বর্ণকারের মৃত্যুর পর মাওলানা রুমি নিজের সাহচর্যের জন্য অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসাবে স্বীয় বিশিষ্ট মুরীদ হুসামুদ্দীন চালপীকে নির্বাচিত করলেন। শামস এবং স্বর্ণকারের ন্যায় তার সাথেও অত্যন্ত মহব্বত ও ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল।
হুসামুদ্দীন চালপী হিজরী ৬২২ সালে কাউনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে সাইয়্যেদ বুরহানুদ্দীনের নিকট মুরীদ হন। তাঁর পরলোক গমনের পর মাওলানা রূমির নিকট মুরীদ হন। তিনি শামস তাবরিজি এবং শেখ সালাহ ভক্ত ছিলেন, তাঁদের নিকট হতেও ফয়ে্জ লাভ করেন। তিনি ব্যবসায়ী ছিলেন এবং মাওলানার সাথে ঘনিষ্ঠতা স্থাপিত হওয়ার পর নিজের সকল চাকর-বাকর, দাস-দাসীকে আদেশ করলেন, তারা যেন নিজ নিজ পছন্দমত কাজ-কারবার করে। ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ সম্পত্তি মাওলানা জালালউদ্দিন রূমির খেদমতে বিলিয়ে দিলেন। সর্বশেষে ক্রীতদাসগুলিকেও আযাদ করে দিলেন।
তিনি মাওলানার সাথে এরূপ আদব রক্ষা করে চলতেন যে, মাওলানার ওযুখানায় কখনও ওযু করতেন না। কোন কোন শীতের রাত্রে শীতের অত্যন্ত প্রকোপ হত। এমন কি, তুষারপাতও হত। এমতাবস্থায় স্বীয় বাড়িতে গিয়ে ওযু করে আসতেন। অপর দিকে মাওলানা রূমিও হুসামুদ্দীন চালপীকে যথাসম্ভব সম্মান করতেন। তাঁর ব্যবহারে দর্শকবৃন্দ মনে করত, ইনি মাওলানার পীর ও মুরশিদ। তিনি পনের বৎসর তার সাহচর্যে ছিলেন। মাওলানার ইন্তেকালের পর তিনি মাওলানার স্থলাভিষিক্ত হন। কেননা, মাওলানা (র) তাঁকে স্বীয় খলীফা নির্বাচিত করেছিলেন। মাওলানার মহাপ্রয়াণের ১১ বৎসর পর তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন।
মাওলানা হুসামুদ্দীন চালপীর সাথে মাওলানা রূমীর এমন প্রগাঢ় মহব্বত ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। যে, চালপী নিকটে না থাকলে মাওলানাকে বিমর্ষ ও বিষন্ন দেখাত। যেই মজলিসে চালপী উপস্থিত না থাকতেন, মাওলানাকে সেখানে অবসাদগ্রস্থ মনে হত। তাছাউফের সূক্ষ্মতত্ত্ব ও মারেফত এর গূঢ় রহস্য বর্ণনায় তার আগ্রহ থাকত না। এই রহস্য সম্পর্কে যারা অবগত ছিলেন, তারা সর্বাপেক্ষা এই বিষয়কেই গুরুত্ব দিতেন যে, চালপী যেন হামেশা উপস্থিত থাকেন, যাতে ফয়েযের সমুদ্র পুরোপুরি প্রবাহিত হয়।
মসনবীর সূচনা, জালালউদ্দিন রুমির জীবনী তে যুগান্তকারী কাব্য গ্রন্থ:
মাওলানা হুসামুদ্দীন চালপীর উৎসাহ এবং অনুরোধে মাওলানা রুমি (র) মসনবী কাব্য রচনা করেন। কেননা, হুসামুদ্দীন চালপী প্রত্যক্ষ করেছিলেন যে, মাওলানা রূমী রচিত ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) বয়েতবিশিষ্ট কিতাব ‘কুল্লিয়াতে শামসে তাবরিজ’ নামক কাব্যগ্রন্থ বিদ্যমান থাকতেও মাওলানার দোস্ত, বন্ধু-বান্ধব ও সহচরগণ শেখ ফরীদুদ্দীন আত্তারের ‘মানতেকততায়ের’ এবং হাকীম সানাঈর ‘হাদীকায়ে সানাঈ’ প্রভৃতি কিতাব পাঠে নিমগ্ন থাকেন।
যদিও মাওলানা জালালউদ্দিন রূমির ‘কুল্লিয়াত’ কিতাব কবিতার বিরাট ভাণ্ডার, কিন্তু উহাতে তাছাওউফের গুপ্ততত্ত্ব এবং তরীকতের গূঢ় রহস্য বর্ণনার তুলনায় এশকের বিভিন্ন মেয়াজের বিবরণী সম্বলিত হৃদয়বিদারক কাহিনীর বর্ণনাই অধিক। কাজেই মাওলানা হুসামুদ্দীন সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন।
এক রাত্রে মাওলানা রুমিকে একাকী পেয়ে মনের কথা ব্যক্ত করলেন যে, হাদীকায়ে সানাঈ’ কিংবা ‘মানতেকুততায়ের’-এর পদ্ধতিতে কোন একটি কিতাব রচনা করলে খুব ভাল হত। একথা শ্রবণমাত্র মাওলানা রুমি(র) স্বীয় পাগড়ীর মধ্য হতে এক টুকরা কাগজ বের করলেন, এতে ১৮টি বয়েত লেখা ছিল। এটাই ছিল মসনবীর প্রথম বয়েত।
মাওলানা জালালউদ্দিন রূমি নির্বাধে অনর্গল মুখে বয়েত আবৃত্তি করতেন আর মাওলানা হুসামুদ্দীন উহা লিপিবদ্ধ করতেন।
লেখা শেষে হুসামুদ্দীন তা উচ্চ আওয়াযে মধুর স্বরে পড়ে শুনাতেন। কোন কোন সময় সারারাত এই কাজে অতিবাহিত হয়ে যেত এবং মসনবীর রচনা ভো্র পর্যন্ত চালু থাকত। এমন এক রাত্রের আলোচনা মসনবীর প্রথম দপ্তরের প্রথম অর্ধাংশের শেষে উল্লেখ আছে।
হে ভোরের মালিক পরওয়ারদিগার! ভো্র হয়ে গেল। তিনি এখন ফজরের নামায আদায় করতে রওয়ানা হচ্ছেন; সুতরাং অনিচ্ছা সত্ত্বেও মসনবী লেখা বন্ধ করতে হয়েছে। আপনি আমার শ্রদ্ধেয় হুসামুদ্দীনের ওযর কবুল করুন।
মসনবী শরীফের প্রথম দপ্তর (পর্ব) লেখা সমাপ্ত হল। এই সময় হুসামুদ্দীনের স্ত্রী-বিয়োগ ঘটে। পত্নীর বিচ্ছেদ-ব্যাথায় হুসামুদ্দীন এতই মর্মাহত হলেন যে, তাঁর তবিয়তের উপর বিরাট প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। তার অশান্তির কারণে মাওলানার তবিয়ত রুদ্ধ ও স্তব্ধ হয়ে গেল। ফলে দুই বৎসরকাল মসনবী রচনা বন্ধ রইল।
দীর্ঘ দিন পর হুসামুদ্দীনের উৎসাহ-উদ্দীপনায় এবং আন্তরিক আকাঙ্খা জ্ঞাপনে পুনরায় মসনবী লেখার কাজ আরম্ভ হল। মাওলানার মৃত্যু পর্যন্ত মসনবীর রচনা চালু ছিল। মসনবী প্রণয়নে সর্বমোট সময় ছিল ১৫ বৎসর। বয়েত বা চরণ সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছাব্বিশ হাজার। এই মসনবী কাব্যগ্রন্থ মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির জীবনীকে পরিপূর্ণ করেছে।
মাওলানার শ্রমসাধনা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য:
তরীকতের পথে মাওলানা রুমীর শ্রম-সাধনা ও প্রচেষ্টা ছিল অতুলনীয়। বিছানা ও বালিশ তিনি মোটেই ব্যবহার করতেন না। স্বেচ্ছায় কখনও শয়ন করতেন না। নিদ্রার আক্রমণ হলে বসে বসে ঘুমিয়ে নিতেন। নামাযের সময় হলে তিনি যে অবস্থায় থাকতেন, তৎক্ষণাৎ কেবলার দিকে ঘুরে যেতেন। তখন তার চেহারার রং পরিবর্তিত হয়ে যেত। নামাযে তিনি একেবারে তন্ময় হয়ে যেতেন। অনেক সময় দেখা গেছে, এশার নামায শেষ করতে ভোর হয়ে গেছে।
একবার কনকনে শীতের মৌসূমে মাওলানা নামাযের মধ্যে এত রোদন করলেন যে, অশ্রু-ধারায় তার সমস্ত দাড়ি ভিজে গিয়েছিল। এমন কি, অত্যাধিক শীতের প্রকোপে দাড়িতে অশ্রু জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু সেদিকে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ ছিল না, যথারীতি নামাজে মশগুল ছিলেন। তিনি স্বভাবতঃ চরম পর্যায়ের সংসার-বিরাগী এবং অল্পে-তুষ্ট লোক ছিলেন।
বিভিন্ন দেশের সুলতান ও বাদশাহগণ নগদ টাকা-পয়সা এবং বিভিন্ন রকমের খাদ্য ও ব্যবহার্য বস্তু তার খেদমতে হাদিয়াস্বরূপ প্রেরণ করতেন। কিন্তু তিনি উহার কিছুই নিজের জন্য না রেখে গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়ার জন্য এবং নিঃস্ব মুরীদবর্গের ভরণ-পোষণের জন্য স্বর্ণকার সালাহুদ্দীন এবং চালপী হুসামুদ্দীনের নিকট পাঠিয়ে দিতেন, অথচ কোন কোন সময় মাওলানার গৃহে খাওয়ার কিছুই থাকত না।
এরূপ সময়ে কোন কোন দিন মাওলানা রুমির বড় ছেলে সুলতান ওলাদ বাহাউদ্দীন পীড়াপীড়ি করলে যৎসামান্য কিছু নিজের জন্য রাখতেন।
যেদিন ঘরে খাবার কিছুই থাকত না, সেদিন মাওলানা খুব বেশী খুশী হয়ে বলতেন, অত আমার ঘর হতে দরবেশীর ঘ্রাণ আসছে। তার দানশীলতা ও পরার্থপরতার অবস্থা এরূপ ছিল যে কোন ভিক্ষুক এসে সওয়াল করলে আবা বা কোর্তা, পরিধানে যা কিছু থাকত, দেহ হতে খুলে তাকে দিয়ে দিত।
একবার তিনি বাজারের উপর দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। ছেলেরা তার হাত চুম্বন করার জন্য দৌড়ে আসতে লাগল । তা দেখে তিনি দাড়ায়ে হাত প্রসারিত করে দিলেন। মাওলানাও তাদের হাতে চুমো খেতেন। অদূরে একটি ছেলে কোন কাজে মশগুল ছিল। সে বলল, মাওলানা! একট অপেক্ষা করুন, আমি আমার হাতের কাজ শেষ করে আপনার হাত চুম্বন করব। ছেলেটি তার কাজ হতে অবসর না হওয়া পর্যন্ত মাওলানা ঐ স্থানে দাড়িয়ে ছিলেন। ছেলেটি কাজ শেষ করে এসে মাওলানার হাত চুম্বন করার পর তিনি নিজের গন্তব্য স্থানে চলে গেলেন।
মহাপ্রয়াণ: মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির জীবনী সমাপ্ত অধ্যায়:
৬৭২ হিজরীতে একদিন কাউনিয়ায় প্রচন্ড ভূকম্পন আরম্ভ হল। ৭ দিন পর্যন্ত মতান্তরে চল্লিশ দিন পর্যন্ত অবিরাম কম্পন হতে থাকল। শহরবাসীরা ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল। অবশেষে মাওলানার নিকট এসে বলল, হযরত! এটা কেমন আসমানী গজব আরম্ভ হল? মাওলানা বললেন, যমীন ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছে, নতুন ও টাটকা গ্রাস চাচ্ছে। ইনশাআল্লাহ, অচিরেই তার আশা পূর্ণ হবে।
এর কয়েকদিন পরে মাওলানার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ল। বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণ চিকিৎসা করতে লাগলেন, কিন্তু চিকিৎসকগণ রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ হলেন। অবশেষে তারা বলল, আপনি কিরূপ কষ্ট বোধ করছেন তা আপনি নিজে ব্যক্ত করুন। মাওলানা সেদিকে বিন্দুমাত্রও কর্ণপাত করলেন না।
তখন লোকেরা মনে করল, মাওলানা আর সামান্য সময়ের মেহমান মাত্র। রোগের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। শহরবাসীরা দলে দলে মাওলানা রুমিকে দেখতে আসতে লাগলেন। বাদশাহ, আমীর, আলেম, শায়খ প্রত্যেক শ্রেণীর লোক আসতে লাগলেন এবং মাওলানার অবস্থা দেখে উচ্চ স্বরে রোদন করতে লাগলেন।
অবশেষে ৬৭২ হিজরীর ৫ই জমাদাসসানী রবিবার দিন সূর্যাস্তের সময় হযরত মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (র) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রাত্রেই গোসল করিয়ে কাফন পরিয়ে রাখা হল। প্রাতে: বিরাট জনতা জানাযা নিয়ে কবরস্থানের দিকে যাত্রা করল। শিশু, যুবক, বৃদ্ধ, আমীর, গরীব, আলেম, মূখ প্রত্যেক স্তরের এবং প্রত্যেক দলের লোক উচ্চস্বরে বিলাপ করতে করতে জানাযার সঙ্গে চলল।
হাজার হাজার লোক শোকাবেগ বরদাশত করতে না পেরে পরিহিত জামা-কাপড় ছিড়ে ফেলতে লাগল। খ্রীস্টান এবং ইহুদীগণ পর্যন্ত ইঞ্জিল এবং তওরাত পাঠ করতে করতে এবং বিলাপ করতে করতে চলতে লাগল। তৎকালীন বাদশাহও জানাযার সঙ্গে ছিলেন। তিনি খ্রীষ্টান এবং ইহুদীদেরকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, মাওলানার সাথে তোমাদের কি সম্পর্ক? তারা উত্তর করল, এই ব্যক্তি যদি আপনাদের মোহাম্মদ (স) হন, তবে তিনি আমাদের মূসা এবং ঈসা (আ) ছিলেন।
অবশেষে সন্ধ্যার লগ্নে জানাযা কবরস্থানে পৌছতে সক্ষম হল। চল্লিশ দিন পর্যন্ত চর্তুদিক হতে বিভিন্ন দেশের লোকজন মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আসতে লাগল। তখন হতে শুরু করে আজও মাওলানা জালালউদ্দিন রূমীর সমাধি জিয়ারতগাহ রূপে পরিগণিত হয়ে আসছে। মৃত্যুকালে মাওলানা রুমির বয়স ছিল ৬৮ বৎসর।
মাওলানা রুমীর মৃত্যুর পর তদীয় সুযোগ্য খলীফা হুসামুদ্দীন চালপী মাওলানার স্থলাভিষিক্ত হলেন। ১১ বৎসর তা’লীম-তরবিয়ত প্রদানের পর ৬৮৩ হিজরীতে ৫৭ বৎসর বয়সে তিনিও পরলোক গমন করেন । চালপীর ইন্তেকালের পর রূমীর সুযোগ্য পুত্র হযরত মাওলানা বাহাওউদ্দিন মুহাম্মদ সুলতান ওলাদ (র) তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন।
শুরুতেই মাওলানা রুমিকে নক্ষত্রের সাথে তুলনা করা হয়েছে। গগনমন্ডলে অবস্থিত নক্ষত্রের সাথে সাহিত্যের এই নক্ষত্রের তফাৎ শুধু এই টুকু যে, ঐই দূর আকাশের নক্ষত্রের আলো ধীরে ধীরে কমে গিয়ে মৃত্যু মুখে পতিত হয় কিন্তু জালালউদ্দিন মুহাম্মদ রুমির জ্ঞানের আলো দিন দিন বেড়েই চলেছে। মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির জীবনী লিখে শেষ করা সম্ভব কিন্তু তাঁর সাহিত্য কর্মের গুন গান, প্রগাঢ়তা, বিস্তার এবং মানুষের মনে তাঁর প্রতি ভালোবাসা লিখে শেষ করা সম্ভব নয়।
সুফী মোহাম্মদ আহসান হাবীব
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply