সুফী সাধক আল্লার ওলি হজরত শামসেতিব্রিজ আদম এবং শয়তান বিষয়টির উপর যা বলে গেছেন তা আদৌ ঠিক নয়। বিষয়টি এতই চমকপ্রদ এবং অবাক করে দেয়। শামসেতিব্রিজ বলেছেন যে, আজাজিল ছয় কোটি বছর ইবাদত করেছেন এবং আজাজিলের ইবাদতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ফেরেস্তাদের সর্দার নিযুক্ত করছেন আল্লাহ।
আজাজিল জ্বিন। আজাজিল কখনোই ফেরেস্তা নন। ফেরেস্তা শব্দটি শুনতে নিষ্পাপ মনে হলেও আসলে আজাজিল হতে ফেরেস্তা নিম্নমানের ! কারণ আজাজিল জ্বিন। মানুষ যেমন নফ্স এবং রূহের অধিকারী, জ্বিনও নফ্স এবং রূহের অধিকারী। এ জন্য দুজনের প্রতিই ইবাদত করার নির্দেশ রয়েছে।
জ্বিনকে আমরা দেখতে পাই না বলে জ্বিনের বিষয়টি সযত্নে এড়িয়ে যাই। কিন্তু দুজনার মাঝেই নফ্স এবং রূহ আছে। জ্বিনেরা যে আল্লাহর অনেক বড় বড় ওলি হন তার দলিল দিল্লীতে হজরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার রওজা মোবারকের পূর্ব পাশে জ্বিন ওলিদের একটি কবরস্থান রয়েছে। এমন কি ওই জ্বিনদের কবরস্থানে জ্বিন ওলিদের নাম পর্যন্ত খোদাই করা আছে।
মনে রাখতে হবে, এটা কিছুতেই ভুলে গেলে চলবে না যে, ফেরেস্তাদের নফ্সই নাই, রূহ তো অনেক পরের কথা। নফ্স এবং রূহ বর্জিত ফেরেস্তারা আল্লাহর সেফাতি নূরের তৈরি। আল্লাহর জাত নূরের নয়। সেফাতি নূর সেদরাতুল মোনতাহা পর্যন্ত যেতে পারে, কিন্তু লা মোকামে প্রবেশ করার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ লা মোকামে একমাত্র আল্লাহর জাত বিরাজমান।
আল্লাহর জাত নূর নিয়ে আল্লাহ পাক মানুষ এবং জ্বিনের শাহারগের নিকটেই আছেন। যেহেতু আজাজিল জ্বিন সেহেতু আজাজিলের মধ্যে নফ্স এবং রূহ আছে এবং আল্লাহ তার শাহারগের নিকটেই আছেন। সুতরাং আজাজিলকে ফেরেস্তাদের সর্দার বানাবার মধ্যে অবাক হবার কিছু নেই।
প্রথম পরিপূর্ণ মানব আদম (অপূর্ণ মানব আদম নয়, বরং অপূর্ণ মানব হলো ইনসান) এর আনুগত্য গ্রহণ করতে তথা সেজদা দিতে আল্লাহ হুকুম করলেন। নফ্স এবং রূহ বর্জিত ফেরেস্তারা সবাই সেজদা করলেন অর্থাৎ আনুগত্য গ্রহণ করলেন, কিন্তু একমাত্র আজাজিল সেজদা দিতে অস্বীকার করাতে অহঙ্কারীতে পরিণত হলো। অহঙ্কারী মানেই হলো ইবলিস।
“ইবলিস” শব্দটি আরবি নয়, ইহা একটি হিব্রু শব্দ। বালাসা হলো অহঙ্কার আর ইবলিস হলো অহঙ্কারী। কেন আজাজিল এই অহঙ্কারটি করলো ? (অবশ্য শামসেতিব্রিজের দৃষ্টিতে) আজাজিল দেখতে পেলো যে, যদি আমি এই অহঙ্কারটি না করি তা হলে আল্লাহর দুনিয়া বানাবার ইচ্ছাটির সার্থকতা কমে যাবে।
আল্লাহ কোনো দোষ করেন না তাই দোষের বোঝাটি নেবার প্রশ্নই উঠে না। যদি আজাজিল নিজের ইচ্ছায় জেনে শুনে এই কলঙ্কের বিষটি গ্রহণ করে তবে শাস্তি তাকে পেতেই হবে। তাই আল্লাহর আদেশ অমান্য করে আজাজিল ইবলিসে পরিণত হল। আজাজিল জেনেশুনে-বুঝে, আল্লাহ পাকের দুনিয়া সৃষ্টি করার ইচ্ছার হুকুম অমান্য করার অপরাধে অপরাধী হয়ে অভিশপ্ত নামক মহা কলঙ্কের বোঝা মাথায় তুলে নিল।
অপরদিকে সত্যদ্রষ্টা আদম, যিনি নূরে মোহাম্মদি সিনায় ধারণ করেন, যিনি রহস্যলোকের গুপ্তজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু নবী, যিনি কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করা নবী, যেখানে ঝড়ের সৃষ্টি হয় অথচ কেন্দ্রবিন্দুতে কোনো ঝড় থাকে না সেইখানে অবস্থান করা নবী আদম, যিনি সেন্টার অফ দি সাইক্লোন অথচ সেন্টারে ঝড় থাকে না বরং ঝড় তৈরি করে, সেই সত্যদ্রষ্টা আদম জেনে-শুনে-বুঝে নিষিদ্ধ গাছের মজা গ্রহণ করলেন। (গন্ধম, মানা করা গাছের ফল, সর্প এগুলো রূপক কথা।)
নিষিদ্ধ গাছের মজাটি জেনে শুনে গ্রহণ না করলে আল্লাহর দুনিয়া তৈরি হয় না। আর দুনিয়া তৈরি না হলে মানব জাতির আগমন হবার পথটি খোলা থাকে না। যদিও আপাতঃ দৃষ্টিতে গুনাহ, যদিও আইনের দৃষ্টিতে গুনাহ, কিন্তু প্রেমের দৃষ্টিতে ইহা মোটেই গুনাহ নয়।
প্রেমের কাছে আজাজিল আর আদমের কী অপূর্ব কোরবানি ! এই কোরবানি কারো চোখে ধরা পড়ে, আবার কারো চোখে ধরা পড়ে না।
সুফী মোহাম্মদ আহসান হাবীব
গবেষক, লেখক ও সাংবাদিক
১৩-০৯-২০০৬ খ্রি:
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply